
ঝুলন দত্ত, কাপ্তাই ( রাঙামাটি) ঃ
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩ বার পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেছিলেন। আড়াই বছরে একটি জেলায় কোন রাষ্ট্র প্রধানের এত সফর দেশের ইতিহাসে প্রথম ও বিরল। ১৯৭৫ সালের ১৪জুন সকালে বঙ্গবন্ধু রাঙামাটির কাউখালি উপজেলায় অবস্হিত বেতবুনিয়া ভূ – উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। অবশেষে কাপ্তাই উপজেলা বাসীর জন্য আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
১৪ জুন ১৯৭৫ সাল, শনিবার বিকেল বেলা। সেদিন আকাশে ছিল মেঘের ঘনঘটা, ছিলো না বৃষ্টি, কাপ্তাইবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি স্বাধীনতার স্হপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বরণ করে নেবার জন্য, কখন তিনি আসবেন। অবশেষে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলো। রাঙামাটি সফর শেষে ১৪ জুন শনিবার বিকেলে হেলিকপ্টার যোগে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সফরসঙ্গীরা কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হেলিপ্যাডে অবতরণ করেন। সেইসময় ঢাকার সাবেক মেয়র মোঃ হানিফ বঙ্গবন্ধুর সফর সঙ্গী ছিল। সেইদিন কাপ্তাই উপজেলার সর্বস্তরের জনগণ, তখনকার মহাকুমা প্রশাসক, জল বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ এবং কাপ্তাই উপজেলা তৎসময়ের উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ কন্ট্রাকটার এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হাতি দিয়ে অভিবাদন জানান। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি জনতার উষ্ণ অভ্যর্থনায় এরপর বঙ্গবন্ধু আসেন পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের রেস্ট হাউস বিদ্যুৎ ভবনে। এইসময় তিনি কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী পেপার মিলকে সময়োপযোগী ও আরো বেশি কার্যকর করার লক্ষ্যে দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। এছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনের সাথে মতবিনিময় করেন। কাপ্তাই অবস্থানকালে তাঁর সম্মানে কাপ্তাই ও চন্দ্রঘোনাবাসীর পক্ষ থেকে মানপত্র পাঠ করা হয় এবং কাপ্তাই উপজেলার স্বনামধন্য সংগীত শিল্পী সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য প্রয়াত অনন্ত চৌধুরী ও কাপ্তাই উপজেলার শিল্পকলা পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাট্য ব্যক্তিত্ব মরহুম শেখ মতিউর রহমানের পরিচালনায় চন্দ্রঘোনা সবুজ সংঘের পক্ষ হতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয় । দুই রাত কাপ্তাই অবস্থান শেষে ১৬জুন সোমবার বঙ্গবন্ধু ঢাকা ফিরে যাওয়ার আগে একটি পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন। আর এ সফরই ছিল বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর। সফরে বঙ্গবন্ধুর সাথে তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর বিশেষ সহকারী আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য তোফায়েল আহমেদ, ঢাকার সাবেক মেয়র মোঃ হানিফ এবং আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক উপস্থিত ছিলেন। সফরে বঙ্গবন্ধু তাঁর সরকারের শিক্ষা ও সংস্কৃতি তহবিল হতে কাপ্তাই শহীদ শামসুদ্দীন স্মৃতি সংসদকে ১০ হাজার টাকা অনুদান দেন।
(তথ্যসূত্র:- “অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা রাঙামাটিতে বঙ্গবন্ধু”–ইয়াছিন রানা সোহেল)
সেদিনের মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত ৯০ বছর বয়সী কাপ্তাই উপজেলার ৭১ এর কাপ্তাই সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ কন্ট্রাকটার এই প্রতিবেদককে জানান, বঙ্গবন্ধু মাগরিবের নামাজের আগে জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হেলিপ্যাডে অবতরণ করেন। কাপ্তাই উপজেলার প্রত্যেকটি ইউনিয়ন হতে শত শত নেতাকর্মীরা আসেন স্বাধীনতার এই মহানায়ককে বরণ করে নিতে। আমরা হাতি দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাই। বঙ্গবন্ধু হাত নেড়ে এবং করমর্দন করে হাসি মুখে সকলের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে বিদ্যুৎ ভবনে চলে যান।
বঙ্গবন্ধুর কাপ্তাই উপজেলা সফর নিয়ে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী জানান, সেসময় আমার বয়স হবে ২২ কি ২৩ বছর। মুক্তিযুদ্ধ করেছি ১৭ বছর বয়সে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বিকেলে আমি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকায় যায়, শত শত নেতাকর্মী, স্কুলের শিক্ষার্থীরা ফুলে ফুলে বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নেন। তিনি জানান, চন্দ্রঘোনা সবুজ সংঘের পক্ষ হতে বঙ্গবন্ধুর সম্মানে প্রথমে ১ ঘন্টার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার কথা ছিল, পরে তৎকালীন মহাকুমা প্রশাসক সেটা ৪০ মিনিট করতে বলে, আবার সেই সময়টা কমিয়ে ২০ মিনিট করতে বললেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরুর পর বঙ্গবন্ধু ১ ঘন্টার বেশী সময় ধরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন এবং মুগ্ধ হন। বিশেষ করে প্রয়াত সংগীত শিল্পী অনন্ত চৌধুরীর গান শুনে তিনি বিমোহিত হন।
সেইদিনের বঙ্গবন্ধুর কাপ্তাই সফরে অংশ নেওয়া তৎকালীন কাপ্তাই উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা ইসমাইল ফরিদ জানান, আমরা শত শত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেদিন উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুকে সাদর সম্ভাষন জানাই, সেদিন মহানায়ককে দেখে কি পরিমাণ আনন্দ পেয়েছি সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
বঙ্গবন্ধুর কাপ্তাই সফরে অংশ নেওয়া কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির সহ সভাপতি ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্হার সাধারণ সম্পাদক বির্দশন বড়ুয়া জানান, আমি সেইসময় নারানগিরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণীতে পড়তাম, তখন স্কুল হতে শিক্ষক হরিনাথ সেন স্যারের তত্ত্বাবধানে আমরা নদী পার হয়ে ২ ট্রাকে করে শিক্ষার্থীরা কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যায়। বঙ্গবন্ধুকে দূর থেকে সেদিন আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।
বর্তমান কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জেলা পরিষদ সদস্য অংসুইছাইন চৌধুরী জানান, আমরা কাপ্তাইবাসী গর্বিত, স্বাধীনতার মহান স্হপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শাহাদাত বরণ করার ঠিক ২ মাস আগে কাপ্তাই সফর করেন। কাপ্তাইবাসী এই দিনটি কখনো ভূলবে না।
বঙ্গবন্ধুর পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর নিয়ে গবেষণা করেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও লেখক সাংবাদিক ইয়াছিন রানা সোহেল। তিনি জানান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর শাসনাসলে মাত্র আড়াই বছরে তিনবার পার্বত্য জেলা রাঙামাটি সফর করেছিলেন। দেশের ইতিহাসে কোন একটি অঞ্চলে কম সময়ে কোন রাষ্ট্রপ্রধানের সবচেয়ে বেশি সফর। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি সফরই পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ প্রতি সফরেই তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যাপক উন্নয়নের চিন্তা করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগের ফলেই দেশের প্রথম উপগ্রহ ভু-কেন্দ্র মাত্র ১৮মাসেই চালু সম্ভব হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প,কর্ণফুলী পেপার মিল পরিদর্শন করে এসবের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। গবেষক ইয়াছিন রানা সোহেল বলেন, বঙ্গবন্ধু দুরদৃষ্টি সম্পন্ন বিশাল ব্যক্তিত্বের রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। তিনি পিছিয়ে পড়া পার্বত্য চট্টগ্রামকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সামাজিক অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই পাহাড়ে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়; যা নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধুর সুদুরপ্রসারী চিন্তার অন্যতম ফসল। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্য,কৃষ্টি, সংস্কৃতিসহ সামগ্রিক উন্নয়নে অভুতপূর্ব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তাঁর সরকার।।
ছবির ক্যাপশনঃ
১) ১৪ জুন ১৯৭৫ সালের বিকেলে কাপ্তাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হাতি দিয়ে অভিবাদন
২) বঙ্গবন্ধু ২ দিন সফর শেষে ১৬ জুন ১৯৭৫ সকালে ঢাকা ফেরত যায়, ফেরত যাওয়ার আগে পরিদর্শন বইতে সাক্ষর করেন তিনি।
৩) তৎসময়ে বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং