
বিশেষ প্রতিবেদকঃ
শেখ হাসিনার পদত্যাগের ১ দফা দাবিতে ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা, ফিরে দেখা জুলাই ৩৫ (২০২৪) প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ এবং শাহবাগ থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত অবরোধ ও ব্যাপক সং’ঘর্ষ…কারফিউ, গুলি আর রক্তে রাঙা আরও একটি দিন চব্বিশের ৪ আগস্ট। তবু রাস্তায় ছাত্র-জনতা, চলছে অসহযোগ আন্দোলন। বন্ধ দোকান-পাট, যান চলাচল। তীব্র ক্ষোভ আর বিক্ষোভে উত্তাল বাংলাদেশ। রাজধানী থেকে মফস্বল সর্বত্রই এক দাবির প্রতিধ্বনি ‘দফা এক, দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ।’ শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে প্রথমে ৬ আগস্ট, পরে ১ দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। কর্মসূচিটি বাস্তবায়নে সারাদেশ থেকে ছাত্র-জনতাকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানানো হয়। রাজধানীর শাহবাগে বিকেল ৩টার দিকে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ গৃহযুদ্ধ সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের দলীয় ক্যাডারদের রাস্তায় নামিয়েছে। তিনি বলেন, যদি আমার ভাইদের বুকে গুলি করা হয়, যদি আমার বোনেরা আর আহত হয়, তাহলে আমরা চুপ করে বসে থাকব না। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় প্রতিরোধ সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। যেখানেই আঘাত আসবে, সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বিকেলে বিক্ষোভকারীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চারজন নিহতের মরদেহ নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান নেন। সেখানে চলে শোক, ক্ষোভ আর প্রতিবাদ। সেখান থেকে শাহবাগ অভিমুখে রওনা হলে, রাজু ভাস্কর্যে বাধা দেয় পুলিশ। অন্যদিকে ছাত্ররা হলের তালা ভেঙে দখল নেয় হলের। সকালটা ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত, কিন্তু দুপুরের দিকে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে মাঠে নামে সরকারদলীয় সমর্থকরা, আর তখনই শুরু হয় সহিংসতা। ঢাকা-সহ অন্তত ২০ জেলায় সরকারপন্থী কর্মী ও পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে অন্তত ৯৩ জন নিহত হন। দেশজুড়ে উত্তাল পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি এবং দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। দুপুর পর থেকে সারাদেশে বন্ধ করে দেয়া হয় ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ মেটার সব পরিসেবা। বন্ধ করে দেয়া হয় মোবাইল ইন্টারনেটও। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাজধানীসহ সব বিভাগীয় শহরে জারি করা হয় কারফিউ। একইসঙ্গে সরকার তিন দিনের জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। রাজধানীর শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী, ধানমন্ডি-২৭, মিরপুর-১০, উত্তরা, রামপুরা ও বাড্ডাসহ বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, দিনমজুর, সমাজকর্মী ও বিভিন্ন পেশাজীবীরা অংশ নেন। ঢাকার বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী ও মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সরকারদলীয় সমর্থক ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। শাহবাগে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পিজি হাসপাতাল ভবনে আশ্রয় নেয়। এ সময় হাসপাতাল প্রাঙ্গণে অন্তত ২৪টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। মিরপুর-১০ হয়ে ওঠে বিক্ষোভের কেন্দ্রস্থল। সেখানে পুলিশ ও অস্ত্রধারী আওয়ামী লীগ কর্মীরা অবস্থান নেয়। গুলির শব্দে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ৪ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক ঘোষণায় বলা হয়, রাজধানী, বিভাগীয় শহর, জেলা সদর, উপজেলা সদর, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও শিল্পাঞ্চলে সন্ধ্যা ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ বলবৎ থাকবে। এর আগে, ১৯ জুলাই মধ্যরাতে সরকার প্রথম অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি করেছিল, যা মাঝে মধ্যে শিথিল করা হয়েছিল। এদিন হাইকোর্ট আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো বন্ধের আবেদন জানিয়ে করা একটি রিট খারিজ করে দেন। আদালত জানান, দায়িত্ব পালনের সময় প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বল প্রয়োগ করতে পারে। দেশজুড়ে চলছে অসহযোগ আন্দোলন। চারদিকে শোক, প্রতিবাদ, রক্ত আর প্রতিরোধের ভিন্ন ভিন্ন স্মৃতি। মার্চ টু ঢাকার কী হবে পরিণতি, তা দেখার অপেক্ষায় ৫ আগস্ট। এরপর লাখো মানুষ নেমে এলেন রাজপথে। আরও একবার বুলেট বোমার কাছে মাথা নোয়ায়নি বাংলাদেশ।