১০ ডিসেম্বরে মানবাধিকার রক্ষা করা শুধু আইনগত বা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়, মোঃ শামছুল আলম

নিজস্ব প্রতিবেদক

 

ডেক্স রিপোর্টঃ

মানবাধিকার হলো প্রতিটি মানুষের জন্মগত মর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রতীক। এটি সেই মৌলিক অধিকার, যা মানুষকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে, নিজের মতামত প্রকাশ করতে, শিক্ষিত হতে, নিরাপদ জীবনযাপন করতে এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে সক্ষম করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতিতে মানুষের মৌলিক অধিকারকে বিভিন্নভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তবে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র (Universal Declaration of Human Rights – UDHR) গ্রহণের পর এই অধিকারগুলোকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো এবং একটি বিশ্বজনীন নীতিমালায় রূপান্তরিত করা হলো। সেই থেকে প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা মানবজাতিকে শিক্ষা দিয়েছিল যে, যদি মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা না হয়, তাহলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা কোনো স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। যুদ্ধকালীন সময়ে মানুষ নানা ধরনের নিপীড়ন ও বঞ্চনার শিকার হয়েছিল। নিরীহ মানুষ হত্যা, হরণ, অত্যাচার ও অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছিল। এসব কুকীর্তির ফলশ্রুতিতে মানবজীবন ও সমাজের ওপর ভয়ঙ্কর ক্ষতি ঘটেছিল। এই অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা গেল, শুধু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক শক্তি দিয়ে কোনো সমাজকে স্থিতিশীল রাখা যায় না; মানুষের মৌলিক অধিকারকে সুরক্ষা দেওয়াই একটি সমাজকে ন্যায়, শান্তি ও স্থিতিশীলতার দিকে পরিচালিত করতে পারে।মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক মানুষের জন্মগত অধিকার রয়েছে এবং এই অধিকার কোনোভাবে সীমাবদ্ধ নয়। জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, ভাষা বা সামাজিক অবস্থার ভিত্তিতে এই অধিকার ভিন্ন নয়। মানবাধিকার শুধুমাত্র স্বাধীনতা বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সীমাবদ্ধ ধারণা নয়; এটি ন্যায়, সমতা ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার একটি জটিল কাঠামো। এই অধিকারগুলোর মধ্যে রয়েছে জীবন যাপন, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, শিক্ষার অধিকার, শ্রমের অধিকার, সমান বৈধ অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার। এই সব অধিকার মানুষের জীবনের মৌলিক ভিত্তি গঠন করে। ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের প্রয়োজনীয়তা কেবল অতীতের অভিজ্ঞতা স্মরণ করাই নয়, এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যও শিক্ষণীয়। বিশ্বে এখনও মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটে—যেমন দারিদ্র্য, বৈষম্য, নিপীড়ন, শিশু শ্রম, নারী নির্যাতন, রাজনৈতিক নিপীড়ন, অভিবাসী ও শরণার্থীর অধিকার হরণ ইত্যাদি। এই ধরনের লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস এসব বিষয়কে সামনে এনে বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দেয় যে, মানবাধিকার রক্ষা করা শুধু আইন বা নীতিমালার বিষয় নয়, এটি প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। মানবাধিকার শুধুমাত্র ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি সামাজিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটি রাষ্ট্রের নাগরিক যদি মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে, তাহলে সেই সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও মানবাধিকারের গুরুত্ব অপরিসীম। জাতিসংঘ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দেশগুলো যখন মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধের চেষ্টা করে, তখন তারা শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করছে না, বরং বিশ্বে শান্তি ও সমতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আইন সহায়তা কেন্দ্র আসক ও মানবাধিকার ফাউন্ডেশন এবং অন্যান্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা মানুষের অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধি, আইনগত সহায়তা, শিক্ষামূলক কার্যক্রম ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তারা সমাজের দুর্বল ও marginalized জনগোষ্ঠীর জন্য সুরক্ষা নিশ্চিত করছে, যাতে তারা তাদের জন্মগত অধিকার ভোগ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নারী ও শিশুর অধিকার রক্ষা, শিশু শ্রম প্রতিরোধ, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধীর সুরক্ষা—এই সকল ক্ষেত্রে এই সংস্থাগুলো কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস শুধুমাত্র দিবস পালন নয়; এটি মানুষকে আন্দোলন ও সচেতনতার পথে পরিচালিত করে। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মানবাধিকার রক্ষা করার জন্য প্রতিটি নাগরিককে অবদান রাখতে হবে। শিক্ষা, সামাজিক সচেতনতা, নীতি প্রণয়ন এবং আইনপ্রয়োগ—এসবের মাধ্যমে মানুষ নিজের এবং অন্যের অধিকার রক্ষা করতে পারে। ইতিহাস প্রমাণ করে যে, মানবাধিকার রক্ষা না করলে সমাজে দারিদ্র্য, বৈষম্য, হিংসা এবং সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। তাই মানবাধিকার রক্ষা শুধু নৈতিক ও আইনগত দায়িত্ব নয়, এটি সামাজিক দায়িত্বেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেখলেই বোঝা যায় যে, মানবাধিকারের প্রতি অবহেলা কেবল ব্যক্তিগত জীবন নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি করে। যা সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা স্থাপন করতে পারে না। আর যেখানে মানবাধিকার নিশ্চিত করা হয়, সেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে, নিজের সম্ভাবনা পূর্ণ করতে পারে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ১০ ডিসেম্বরের এই দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মানবাধিকার রক্ষা আমাদের নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্য, যা শুধু আইন বা নীতিমালার উপর নির্ভরশীল নয়, বরং মানবিক সচেতনতা ও মানবিক মূল্যবোধেরও অংশ।সংক্ষেপে বলা যায়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস আমাদের শিক্ষা দেয় যে মানুষের জন্মগত মর্যাদা ও অধিকার সমান এবং অবিচ্ছেদ্য। এই অধিকার রক্ষা করা সকলের নৈতিক, সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক দায়িত্ব। মানবাধিকারের প্রতিটি সংগ্রাম, শিক্ষা ও সচেতনতা আমাদেরকে শেখায় যে, শান্তি, সমতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য মানবাধিকার অপরিহার্য। বাংলাদেশে এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি এই প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ১০ ডিসেম্বরের দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানবাধিকার রক্ষা করা শুধু আইনগত বা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়, এটি প্রতিটি মানুষের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব, যা বিশ্বের শান্তি, ন্যায় এবং সমতার ভিত্তি সুদৃঢ় করতে সাহায্য করে।

সোস্যাল নেটওয়ার্ক

সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত