অপসাংবাদিকদের ভিড়ে প্রকৃত সাংবাদিকদের মর্যাদা আজ ধুলায় ভূলুণ্ঠিত। কেনো এমন হচ্ছে?

নিজস্ব প্রতিবেদক

শিব্বির আহম্মদ ওসমানঃ

তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সাংবাদিকের অভাব বোধ করি তেমন নেই দেশের প্রতিটি জনপদে। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাংবাদিক হতে একটি এন্ডুয়েট থাকলে হয়। আর নামমাত্র পেইজ খুলে কোন রকম কপি পেস্ট করে অন্যের সংবাদ নিজের নামে চালিয়ে বনে যান সাংবাদিক। আর এমন সাংবাদিকের দৌঢ়তে আজ যারা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেন তারা প্রতিনিয়ত লজ্জাবোধ করেন এমন সাংবাদিকদের অবস্থান দেখে। আরো বাকরোধ হওয়ার মত ঘঠনা হল এখন সাংবাদিক হতে তেমন যোগ্যতা লাগে না । দেশে এমন সাংবাদিকও পাবেন যারা পেশায় পান দোকানদার, কখনও কসাই । আজ অপসাংবাদিকতা ও এমন সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে বিভ্রান্ত দেশ ও জাতি। এখন অনেকের জিজ্ঞেসা সাংবাদিকতা আসলে এত সহজ? শিক্ষা সাংবাদিকতা পেশায় অন্যতম বুনিয়াত। সমাজের অসঙ্গতি দূর করার ক্ষেত্রে এবং সমাজ বিনির্মাণে সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। আর সুশান ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাংবাদিকদের ভূমিকা অপরিহার্য। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে নিজস্ব স্বক্রীয়তা নিয়ে গর্ণমাধ্যমকর্মীরা দেশমাতৃকার কল্যানে নিজেকে বিলিয়ে দেন। । আজ এই স্তম্বটি দ্বিধা বিভক্ত। নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত। অপসাংবাদিকদের দৌরত্বে প্রকৃত সাংবাদিদের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত। কেন এমন হচ্ছে?যেখানে একজন সাংবাদিক দেশ, সমাজের কল্যানে নিজেকে নিবেদিত করে জনকল্যানে পেশাগত দায়িত্ব পালন করবেন। সেইখানে আজ সাংবাদিকতা প্রশ্নবিধ। সাংবাদিকতা নামক মহান পেশার সঠিক আদর্শ উদ্দেশ্য উল্টে ফেলা হচ্ছে । স্বচ্ছ ও সৎ সাংবাদিকদের আর নানা ক্ষেত্রে বিতর্কিত করা হচ্ছে। প্রতিনিয়িত নানা স্বার্থে গণমাধ্যমগুলোকে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। কারা করছে এসব? আজ বাণিজ্যের ভিড়ে প্রকৃত সাংবাদিকরা খেয় হারিয়েছে। আজ কেনো মর্যাদাসম্পন্ন পেশা মর্যাদা হারাচ্ছে। কেনো শুদ্ধতার মাঝে ঢুকে পড়ছে নাম সর্বস্ব অপসাংবাদিকতা। এখন সাংবাদিকতা পেশা নয় অসুস্থ ব্যবসা। অনেকটা অর্থের বিনিময়ে আন্ডরগ্রাউন্ড পত্রিকা, নাম সর্বস্ব অনলাইন পত্রিকা,অনলাইন টিভি চ্যানেল বা ভুইফুর টিভি চ্যানেলের পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে আর তাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে সাংবাদিকতার নামে করছে হরদম প্রতরণা। হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ । যা বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতা আর সংবাদপত্রের প্রধানতম মাথা ব্যাথার কারণও বটে। প্রকৃত সাংবাদিকদেরও আজ মানুষ মুল্যায়ন করছেন না অনেকাংশে। কেন এই পরিস্থিতি? সত্যি বলতে কি দেশে সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহারের কোন নীতিমালা নেই। নেই কোন নিয়ম। এখুনি এই সুযোগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর প্রকৃত সাংবাদিকদের সাহসী উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।শুরু থেকে আমাদের দেশে সাংবাদিক হতে কোনো সুনির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না। হুট করেই সাংবাদিক হয়ে যেতে পারে যে কেউ। তবে সুশিক্ষিত ও মানসম্পন্ন সাংবাদিক ও কলামিস্ট এ দেশে অনেক। যাদের ক্ষুরধার ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনী দ্বারা সমাজের অনেক অসঙ্গতি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলে আমাদের সমাজকে সচেতন করে তোলেন প্রায়ই।অপরদিকে অপসাংবাদিকতা ইদানীং সাংঘাতিক রকম বেড়ে গেছে। অপসাংবাদিক সৃষ্টি এক ধরনের সাংবাদিকতা নির্যাতন। আমরা চাই, সাংবাদিকতা পেশা যেনো আগের সৎ ও নির্ভীক চেহারায় ফিরে আসে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে যারা এসব অপসাংবাদিক তৈরি করছে তারা সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যেই তা করছে। এটা কোনো সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রও হতে পারে। এসব ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে হবে। তাদের প্রতিহত করতে হবে। নইলে বড্ড বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে এ মহান পেশার। সাংবাদিকতা একটি স্পর্শকাতর পেশা। যে কারো হাতে যেভাবে ছুরি কাঁচি তুলে দিয়ে অপারেশনের সার্জন বানিয়ে দেয়া গ্রহণযোগ্য হয় না, একইভাবে যে কারো হাতে পরিচয়পত্র, কলম-ক্যামেরা-বুম তুলে দিয়ে তাকে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারের দায়িত্ব দেয়াটাও গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়। সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা অথচ আজ এই মহান পেশায় ৮ম শ্রেণী পাশ না করেও এলাকায় টাউট হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিরা ঢাকাসহ জেলা শহর থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন অখ্যাত-কুখ্যাত পত্রিকার পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে সাংবাদিক বনে যায় এবং প্রশাসনে ও রাজনৈতিক মহলে উদ্দেশ্যমূলক খবরদারি করে। আর প্রশাসনে খবরদারিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ঐ টাউট সংবাদকর্মীরা সহজ সরল মানুষকে বস্নাকমেইলিং করছে। স্বঘোষিত সাংবাদিক হওয়া কিছু টাউট সংবাদকর্মী মোটরসাইকেলে অথবা প্রাইভেট কারে সাংবাদিক বা প্রেস লিখে অবাধে চলাফেরা করছে। সরকারি বেসরকারি দপ্তরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব টাউট সংবাদকর্মীদের সমীহ করছে, আবার তাদের অপকর্মে সহযোগিতা নিচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। শুধু এখানেই থেমে নেই টাউট হিসেবে চিহ্নিত এসব সংবাদকর্মীরা অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সমস্যাগ্রস্ত মানুষদের সরলতার সুযোগ নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি বিপদগ্রস্ত মানুষদের আরও বিপদে ফেলছে। সময় এসেছে এদের চিহ্নিত করার। এরা আসলে সমাজ সুব্যবস্থার শত্রু। আসুন, আমরা এদের একে একে চিহ্নিত করে তাদের মুখোশ উন্মোচন করি আর নিজ নিজ অবস্থানে থেকে এদের প্রতিহত করি। সাংবাদিকতার নীতিমালা প্রয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে কারা নীতিমালা করবেন? নীতিমালা কি হবে? আর এসব সামলাবেই বা কে? আমি সাংবাদিকদের এ জন্য একটি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এবং বিধিমালা তৈরির পক্ষে। এ বিষয়টি কেউ সাংবাদিক নিয়ন্ত্রণ ভাববেন না দয়া করে। প্রকৃত সাংবাদিকদের স্বার্থেই তা করা যেতে পারে। আর সাংবাদিকদেরই এ ব্যাপারে বেশি এগিয়ে আসতে হবে। সব পেশারই লাইসেন্স প্রদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান থাকে। প্রকৌশলী; আইনজীবী এমনকী চিকিৎসা বিজ্ঞানের সব বই পড়ে ঝালাপালা হয়ে গেলেও চিকিৎসা কিংবা নিজ নিজ কর্ম শুরু করার আগে আপনাকে সনদ নিতে হবে। এই সনদ গ্রহণের মাধ্যমে আপনি নূ্যনতম নিয়মনীতি ও পেশাগত সততার প্রতি অঙ্গীকার করতে হয়। আপনি আইন পাস করলেও সরাসরি বিচার কার্যে অংশ নিতে পারবেন না, এ জন্য আপনাকে তালিকাভুক্ত ও সনদধারী আইনজীবী হতে হবে। অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে হলেও আপনাকে শুধু হিসাববিজ্ঞান জানলে চলবে না, সংশ্লিষ্ট পেশাগত প্রতিষ্ঠানের সনদ নিতে হবে। এসব সনদের কারণে একজন পেশাজীবী তার নিজের পেশার প্রতি সৎ থাকার অঙ্গীকার করেন। সনদ থাকার কারণে আমরা সাধারণ মানুষরা বুঝতে পারি যে এই চিকিৎসক কী আইনজীবী আসলেই আমাকে সেবা দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন কি-না। সেবা প্রদানে গুরুতর কোনো অনৈতিকতা থাকলে আমরা বিচারপ্রার্থী হতে পারি এবং দায়ী ব্যক্তির সনদ বাতিল করে তাকে পেশা থেকে সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা আছে। তাই এই ধরনের পেশাদারিত্বের নিবন্ধন ও সনদ একজন মানুষকে নিজ পেশায় দায়িত্বশীল হতে বাধ্য করে। থাকে জবাবদিহিতাও। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তা হওয়া দরকার। কারণ সাংবাদিকদের লেখনীর ওপর ভালোমন্দ অনেক কিছুই নির্ভর করে। সে ক্ষেত্রে সাংবাদিকতায় দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরই আসতে হবে। এতে করে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার মর্যাদা বাড়বে। বিভাগ, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের প্রকৃত তালিকা থাকা প্রয়োজন। প্রত্যাশা করি সাংবাদিকরা সব বিভেদ ভুলে এক হবেন; অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার মর্যাদা যেনো ভূলুণ্ঠিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে সাংবাদিক নেতাদের। সাংবাদিকদের বিভক্তি আর অপসাংবাদিকদের অপতৎপরতার সুযোগ নিচ্ছে রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্বৃত্তরা। নিরাপত্তার অভাবে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মুক্ত সাংবাদিকতার দ্বার। ফিরে আসুক সাংবাদিকতার মর্যাদা; নিরাপদ আর মুক্তহাতে কলম ধরার পরিবেশ ফিরে পাক সাংবাদিকরা; রাহুমুক্ত হোক সংবাদপত্র। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখন : বিশিষ্ট গণমাধ্যমকর্মী ও
আহবায়ক
চট্টগ্রাম সাংবাদিক ফোরাম।

সোস্যাল নেটওয়ার্ক

সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত