চতুর্থ শিল্প বিপ্লব: লেখক : তারিকুল আলম অতিরিক্ত জেলা ম্যজিস্ট্রেট, নোয়াখালী

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ

প্রাথমিক ধারণা :আমরা জানি চতুর্থ শিল্প বিপ্লব “Industry 4.0” নামে পরিচিতি লাভ করছে। আঠারো শতকের শেষার্ধে শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডে যে বিপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয় তাহাই শিল্প বিপ্লব নামে পরিচিত। শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ড বিশ্বের প্রথম শিল্প উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং দেশটির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের দিক থেকে তারা এগিয়ে যায়। তাই ইংল্যান্ডকে “পৃথিবীর কারখানা ” বলা হয় । সৃষ্টিলগ্ন হতে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত ৩টি শিল্প বিপ্লব হয়েছে। যথা-
(ক) প্রথম শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হয় ১৭৬০ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিস্কারের মাধ্যমে, যাহা উৎপাদন শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটায় । এর মূল প্রভাবক ছিল বাষ্পীয় ইঞ্জিন এবং ফলাফল ছিল উৎপাদন শিল্পের সম্প্রসারণ।
(খ) দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হয় উনিশ শতকের শেষার্ধে ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে । ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিস্কার হয়, যার মাধ্যমে উৎপাদন শিল্পে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয় । এর মূল প্রভাবক ছিল বিদ্যুৎতের উৎপাদন ও ব্যবহার এবং ফলাফল ছিল উৎপাদন শিল্পের আমূল পরিবর্তন । (গ) তৃতীয় শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হয় ১৯৬০ সালে তথ্য প্রযুক্তি উদ্ভবের ফলে। এতে বিভিন্ন ভারী ও মাঝারী শিল্পে অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটে। এর মূল প্রভাবক ছিল কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি এবং ফলাফল ছিল বিভিন্ন শিল্পের অভাবনীয় পরিবর্তন ।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব : চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এর ধারনাটি ০১/০৪/২০১৩ সালে জার্মানীতে আনুষ্টানিকভাবে উপস্থাপিত হয়। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবটি হবে মূলত ডিজিটাল বিপ্লব। ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে কল-কারখানা গুলোতে ব্যাপক হারে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসে আমূল পরিবর্তন। আগের শিল্প বিপ্লব গুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, মানুষ যন্ত্রকে পরিচালনা করছে । কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে যন্ত্রকে উন্নত করা হয়েছে, ফলে যন্ত্র নিজেই নিজেকে পরিচালনা করছে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে জীবনমান উন্নয়নে কি প্রভাব বিস্তার করবে তা নিয়ে দুইটি মতবাদ প্রচলিত আছে । যথা- (ক) একদল বিশেষজ্ঞ মতবাদ দেন যে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে মানুষের আয়ের পরিমান ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে। বিশ্বের পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল প্রযুক্তি আনবে ব্যপক পরিবর্তন। ইতিবাচক প্রভাব পড়বে আন্তজার্তিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে । (খ) আরেক দল বিশেষজ্ঞ মতবাদ দেন যে, ডিজিটাল বিপ্লব বিশ্বের অসাম্য ও দারিদ্র্যে পরিস্থিতিতে আরও দুর্বিষহ করে তুলবে । ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি ফলে মানুষের দ্বারা সম্পন্ন অনেক কাজ রোবট দিয়ে সম্পন্ন করা হবে। এতে নতুন কর্মসংস্থানের সমস্যা সৃষ্টি হবে। এছাড়া শ্রম বাজারে কর্মদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমে যাবে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সমস্যায় ফেলে দিবে।

সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে ও নীতি নির্ধারণের সময় ডিজিটাল বিপ্লব আনবে বড় পরিবর্তন। প্রযুক্তি বিপ্লব সরকারি সেবা সমূহকে সাধারণ মানুষের নাগালে নিয়ে আসবে, অপরদিকে ডিজিটালাইজেশনের সহজ লভ্যতা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ঝুঁকি বাড়াবে। নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবই যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই মর্মে তথ্য প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা আশংকা করছেন।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আলোচিত প্রযুক্তি : (ক) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (খ) ক্লাউড কম্পিউটিং (গ) ইন্টারনেট অব থিংস (ঘ) বøক চেইন প্রযুক্তি (ঙ) থ্রিডি প্রিন্টিং (চ) কোয়ান্টাম কম্পিউটিং (ছ) উন্নত মানের জীন প্রযুক্তি (জ) বিগ ডেটা এ্যানালাইট্রিক (ঝ) হরাইজন্টাল ও ভার্টিক্যাল সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন (ঞ) সাইবার সিকিউরিটি(ট) রোবোটিক্স।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে প্রভাব বিস্তারকারী প্রযুক্তি সমূহ :
(ক)Internet of Thinks (IoT): আমাদের চারপাশে সকল বস্তু যখন নিজেদের মধ্যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ শুরু করে এবং নেটওর্য়াক গড়ে তুলে তাহাই ইন্টারন্টে অব থিংস। ইতোমধ্যে গুগল হোম, এ্যামাজনের আলেক্সার কথা আমরা জেনেছি । যা আপনার ও আমার বাড়ীর বাতি, সাউন্ড সিস্টেম ও ফটক সহ অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। উদাহরন স্বরুপ বলা যায় যে, আপনার বাসার চুলাকে একবার শিখিয়ে দিবেন যে, কখন কি খেতে আপনি পছন্দ করেন। ধরুন বৃষ্টির দিনে আপনি খিচুড়ী খেতে চান সেটা আপনার চুলা এটা মনে রাখবে এবং বাহিরে বৃষ্টি হলেই আপনার জন্য সেদিন খিচুড়ী রান্না করে রাখবে।

(খ)Cloud Computing: ক্লাউড কম্পিউটিং মানে কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কের উপর কোন চাপ না পড়া। যে কোন স্টোরেজ সফটওয়ার এবং যাবতীয় অপারেটিং সিস্টেমের কাজ চলে যাচ্ছে হার্ড ডিস্কের বাহিরে। শুধুমাত্র ইন্টারনেট কানেকশন থাকলেই ক্লাউড সার্ভারে কানেক্ট হয়ে সব সুবিধা নেয়া যাবে। কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক নষ্ট হলেও ক্লাউড সার্ভার ডাউন হওয়ার সুযোগ থাকবে না । ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের কাজ গুলো যে কোন স্থানেই বসে মোবাইলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

(গ)Artificial Intelligence (AI) : ইহাকে মেশিন ইন্টিলিজেন্স বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে কম্পিউটার বিজ্ঞানের উৎকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত হলো কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা। আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স যে ৪টি কাজ করে তা হলো (র) কথা শুনে চিনতে পারা (রর) নতুন জিনিস শেখা (ররর)পরিকল্পনা করা এবং(রা)সমস্যার সমাধান করা । বর্তমানে সকল স্মাটফোনেই আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স এর ব্যবহার হচ্ছে গ্রাহকের অভ্যাস ও প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী কাস্টমাইজ সেবা প্রদান করার ক্ষেত্রে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অটোমেশনের মতো নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে শিল্প ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব পরিবর্তনের সম্ভবনা রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মানুষের কাজ দখল করে নেবে উন্নত মানের মেশিন ও রোবট, ফলে অনেক লোক তাদের কর্মসংস্থান হারাবে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ৬০% , আসবাবপত্র শিল্পে ৫৫%, প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্য শিল্পে ৪০%, চামড়া ও জুতা শিল্পে ৩৫% এবং সেবা শিল্পে ২০% লোক কর্মহীন হয়

সোস্যাল নেটওয়ার্ক

সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত