
রোটারিয়ান গোলাম আকবর চৌধুরীঃ
চেরাগী পাহাড়: চট্টগ্রামের মূল পরিচয়
দেশের দ্বিতীয় রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রাম মূলত বাণিজ্যিক নগরী হিসেবেই প্রসিদ্ধ। সমুদ্র বন্দর ও প্রচুর শিল্পকারখানার মাধ্যমে চট্টগ্রাম জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু ইতিহাস, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ও সৌন্দর্য্যের কারণে চট্টগ্রাম প্রাচ্যের রাণী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল বহু আগে। এসবের সমন্বয়ের চট্টগ্রাম নগরীর ঠিক মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে চেরাগী পাহাড় বা চেরাগী মোড়। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ও সৃজনশীল চর্চার অন্যতম ক্ষেত্র চট্টগ্রামের চেরাগী মোড়। এক দিকে আন্দরকিল্লা মোড়, পেছনে ডিসির পাহাড়, বিপরীতে জামালখান সড়ক। এর মাঝেই অবস্থিত চেরাগী মোড়।
চেরাগ থেকে চেরাগী:
এদেশে ইসলাম প্রসারে সুদূর আরব থেকে আসা সূফি সাধকরাই সবসময় ভূমিকা রেখেছেন।
কথিত আছে যে, প্রায় সাতশত বছর আগে সুফি সাধক আউলিয়া বদর শাহ (রহ:) সমুদ্রে ভাসমান একটি পাথর খণ্ডে আরোহণ করে চট্টগ্রামে আগমন করেন। তিনি মূলত ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিলেন। কিন্তু তখন চট্টগ্রাম ছিল গভীর পাহাড়-পর্বতে ঘেরা এবং জন-মানবহীন। এখানে ছিল জ্বীন-পরিদের আবাসস্থল।
আউলিয়া হজরত বদর শাহ (রহ:) একটি অলৌকিক চেরাগ সাথে নিয়ে এসেছিলেন। সেটি হাতে নিয়ে তিনি যখন একটি পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করেন তখন জ্বীন-পরিরা তাঁকে বাঁধা দেয়। তারা বলে, এখানে মানুষের কোনো স্থান নেই।
রাতের অন্ধকার নেমে এলে হজরত বদর শাহ (রহ:)অতি সুকৌশলে তাঁর চেরাগটি বা প্রদীপটি রাখার জন্য জ্বীন-পরিদের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন। জ্বীন-পরিরা তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করার পর বদর আউলিয়া তাঁর অলৌকিক চেরাগটি জ্বেলে দেন। আর তখন তার তীব্র তেজ সহ্য করতে না পেরে জ্বীন-পরিরা চট্টগ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়। এরপর থেকেই এখানে মানুষের বসবাস শুরু হয়। আর পাহাড়টির নাম হয় চেরাগী পাহাড়। কালক্রমে চেরাগি পাহাড় চত্বরটি হয়ে উঠে চেরাগী মোড়।
আজকের চেরাগী:
আজকের সময়ে চেরাগী মোড় বললেই চোখের সামনে ভেসে উঠে অসংখ্য দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা, টিভি চ্যানেলের অফিস। পাশাপাশি রয়েছে প্রচুর প্রকাশনা সংস্থা, মুদ্রণ, হকার সমিতির কার্যালয়। মূলত চেরাগী মোড়কে কেন্দ্র করেই চেরাগী মোড়, আন্দরকিল্লা মোড় থেকে কাটা পাহাড়, চন্দনপুরা পর্যন্ত গড়ে উঠেছে বিশাল ছাপা খানার বাজার। যেখানে সকাল সাতটা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ছাপা খানার মেশিন ঘুরতে থাকে।
চেরাগী মোড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান, ব্যান্ড দল, ব্যাংক-বীমা, অ্যাডফার্ম, স্টেশনারি, কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র, হাসপাতাল, মন্দির, হল সর্বোপরি সকল প্রকার বাণিজ্যিক, সমাজকল্যাণমূলক ও শিল্প সাহিত্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিনই এখানে ছুটে আসছে শহর বন্দর গ্রামগঞ্জ হতে শত শত হাজার হাজার মানুষ। বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রামের অন্যতম এ চেরাগী পাহাড়ে দৈনিক লেনদেন হচ্ছে কোটি কোটি টাকার। ঢাকার পরেই প্রকাশনা বাজারের দিক থেকে চট্টগ্রামের অবস্থান দ্বিতীয় যা চেরাগীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
সংস্কৃতিকর্মীদের আড্ডা মুখর চেরাগী:
চট্টগ্রামের কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যজন, শিল্পী, গায়ক, সৃজনশীল বইয়ের পাঠক- লেখক, সংগঠক, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিককর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের আড্ডার অন্যতম ঠিকানা চেরাগী। মানুষ তার প্রাণে শান্তি খুঁজে পায় সংস্কৃতি চর্চায়। চেরাগী মোড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা সাংস্কৃতিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিল্পীরা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির ধারক বাহক। যা মানুষকে শুদ্ধ চর্চায় ধাবিত করে। গভীর বনে গেলে যেমন পাখির কলকাকলি ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না, চেরাগী মোড়ও তেমনি সবসময় শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি কর্মীদের গুঞ্জনে মুখরিত থাকে।
ভোরের চেরাগী:
ভোর পাঁচটা থেকে ছ`টার মধ্যে ঢাকার দৈনিক পত্রিকাগুলোর গাড়ী গিয়ে হাজির হয় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোও ততোক্ষণে ছাপাখানা থেকে বের হয়ে এসে হাজির হয় চেরাগীতে। হকার অফিসগুলোর সামনে শুরু হয় হকারদের ব্যস্ততা। গরম গরম পত্রিকাগুলোর মৌ মৌ সৌরভে তখন মুখরিত চেরাগীমোড়। শুধু খবরের উত্তেজনা নয়, এক সদ্য ছাপা হওয়া সংবাদপত্রের সুগন্ধ এক মনমাতানো পরিবেশ সৃষ্টি করে। শুরু হয় হকারদের ছুটে চলা। সাইকেলের পেছনে পত্রিকা বেঁধে টুং টাং শব্দ করে যখন হকাররা ছুটে চলে তখন নগরে ঘোষিত হয় নতুন বারতা।
সন্ধ্যার আড্ডা:
বসার জায়গা নেই বললেই চলে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা। আজাদী ভবন, বঙ্গবন্ধু ভবন, লুসাই ভবনের নিচে তিল ধারনের ঠাঁই থাকে না। হাতে চায়ের কাপ, ঠোঁটে সিগারেট এখানে কমন দৃশ্য। চটপটি, ফুচকা,নানারকমের পিঠাও থাকে।
সাংবাদিকপাড়া হিসেবে খ্যাত চেরাগী পাহাড়ের সন্ধ্যা কালীন আড্ডায় উঠে আসে দেশ বিদেশ নিয়ে নানা আলোচনা, সমালোচনা, তর্ক। তারুণ্যের বিদ্রোহের যে স্বরূপ তা অবলোকন করতে হলেও আসতে হবে চেরাগীতে।
মধ্য রাতের টংগাড়ীর চা:
চেরাগীর মোড় ও আশেপাশের টংয়ের চা দোকানগুলো খোলা থাকে গভীর রাত পর্যন্ত। রাত ২টা-৩টা বা মধ্য রাতের আড্ডাবাজরা ভিন্ন ক্যাটাগরির হয়। এসব দোকান ঘিরে যেমন থাকে রাত জাগা সাংবাদিক তেমনি থাকে কবিতার পরের লাইন মেলানোর নেশায় ছুটে চলা দিশেহারা যুবক।
বইঘর:
চট্টগ্রামের সব বড় বড় প্রকাশনা ও বইয়ের দোকানগুলো চেরাগী মোড় ও আশপাশে অবস্থিত। শুধু ফেব্রুয়ারি নয়, বরং সারাবছরই দেশবিদেশের খ্যাতিমান লেখক গবেষকদের আড্ডা থাকে এসব প্রকাশনা ও বইয়ের দোকান ঘিরে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা সংস্থা হলো বলাকা প্রকাশন, শৈলী প্রকাশন, আবীর প্রকাশন, নন্দন, শব্দচাষ, বাতিঘর ইত্যাদি। এখানকার বড় বইয়ের দোকান, বাতিঘর, নন্দন, প্রথমা, গ্রন্থনিলয় বেশ প্রসিদ্ধ। কথাকলি নামের বইয়ের দোকানটি কালের সাক্ষী।
ফুলের বাজার চেরাগী:
চেরাগী পাহাড়, এই এলাকাকে অন্যতম নান্দনিক রুপ দিয়েছে এখানে অবস্থিত প্রচুর ফুলের দোকান। দেখলে মনে হবে এ যেন এক ফুলের রাজ্য। এর সুবাসে মুগ্ধ করে রাখে সবাইকে।
ডিসি পাহাড়:
পাহাড় কেটে কেটে বানানো নগরী চট্টগ্রাম। চেরাগীর মোড়ের পেছনে অবস্থিত বিশাল ডিসি`র পাহাড়। যেখানে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের বাসভবন অবস্থিত। এই পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতকৃত মঞ্চ। কবি নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত এ মঞ্চে সারা বছরই কোন না কোন অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। তাছাড়া তরুণ তরুনীদের ঘনিষ্ট সাহচর্য বা কোন আপনজনের সান্নিধ্যে আলাপচারিতার জন্যও ডিসি হিল নিরাপদ।
নাট্যদল, আবৃত্তি সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন:
চেরাগী মোড়কে কেন্দ্র করে কাজ করছে চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি নাট্য সংগঠন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিনোদিনী, ফেইম, লোক থিয়েটার, প্রতিনিধি, প্রতিভাস, ইত্যাদি। আবৃত্তি সংগঠনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বোধন, প্রমা, ত্রিতরঙ্গ, কিংবদন্তি, অনার্য অন্যস্বর, শব্দনোঙর ইত্যাদি। সাংস্কৃতি সংগঠনগুলোর মধ্যে চারণ, উদীচী, সমগীত, অবসর, লোক সাংস্কৃতিক মঞ্চ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
লিটলম্যাগ:
কিছুদিন আগেও শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে প্রথা ভাঙ্গার মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হতো লিটলম্যাগকে। চট্টগ্রামের লিটলম্যাগ আন্দোলন দীর্ঘদান ধরে আবর্তিত হচ্ছে চেরাগী মোড়কে কেন্দ্র করে। লিটলম্যাগ কর্মী, লেখক, সম্পাদকরা এখানে স্বপ্ন বুনেন এক নতুন পৃথিবী গড়ার।
ইট পাথরের নগরায়নে যখন নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইবে তখনই সামান্য স্বস্তি মেলবে চেরাগী মোড়ের আড্ডায়। চেনা-অচেনা বড় কথা নয়, এখানে সবাই সবার পরিচিত। সবাই সবার কথা শুনে। নিজের মতাদর্শ বুক ফুলিয়ে বলার এমন সুযোগ দেশের আর কোথায় আছে!