
ঝুলন দত্ত, কাপ্তাই ( রাঙামাটি) প্রতিনিধিঃ
আবহমান বাংলার চিরায়িত সংস্কৃতির অন্যতম একটি উপদান যাত্রাশিল্প। সামাজিক, ঐতিহাসিক, লোককাহিনী এবং ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের উপর রচিত যাত্রাপালায় মানুষের সুখ দুঃখের গল্প, পৌরাণিক ইতিহাস, জীবনবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ সহ নানা অনুষঙ্গ বিভিন্ন চরিত্র ফুটিঁয়ে তোলের অভিনেতারা।
আজকে কাপ্তাইয়ের একজন যাত্রাশিল্পির ইতিহাস পাঠকদের মাঝে তুলে ধরবো। যিনি ৮ শতের মতো যাত্রা, থিয়েটার এবং পথ নাটকে অভিনয় করেছেন। তিনি হলেন প্রখ্যাত অভিনেতা পরিচালক রনজিত মল্লিক। যাঁকে গত ৩ জুলাই নাট্যঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখায় কাপ্তাই উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক নাট্য সম্মাননা প্রদান করা হয়।
বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর) দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনার কেপিএম কয়লার ডিপু আবাসিক এলাকায় অভিনেতা রনজিত মল্লিক এর পুত্র বাউল শিল্পী বসুদেব মল্লিক এর বাসায় কথা হয় একসময়ের সাড়া জাগানো অভিনেতার সাথে। ৭৫ বছর বয়সী এই অভিনেতা বয়সের ভারে অসহায় হয়ে পড়েছেন, ঠিক মতো এখন আর চলাফেরা করতে পারেনা, কথা বলতেও কষ্ট হয় এই অভিনেতার। নানা রোগ ব্যাধি বাসা বেঁধেছে শরীরে। স্মৃতিশক্তি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে তিনি জানান। তবুও পুরনো স্মৃতি কিছুটা স্মরণ করেন তিনি।
জানালেন ৭৫ বছরের এই জীবনে তিনি প্রায় ৮শত বিভিন্ন মঞ্চে যাত্রা ও নাটকে অভিনয় করেছেন। তাঁর জীবনের প্রথম অভিনয় করা হয় ১৯৫৬ সালে। তখন মাত্র ৮ বছর বয়সে তাঁর পিতা প্রয়াত অভিনেতা সতীশ মল্লিকের অনুপ্রেরণা নিয়ে চন্দ্রঘোনা কেপিএম হরিমন্দিরে দুর্গাপুজা উপলক্ষে একটি যাত্রাপালায় অংশ নিয়ে শুরু করেন অভিনয় জগৎ। যাত্রাটির নাম ছিলো তরণীর বধ। তরণীর বধে ছোট বালকের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। যেই যাত্রাটির পরিচালক ছিলেন তৎকালীন কেপিএম এ কর্মরত পরিচালক বিভুতী রঞ্জন বড়ুয়া। সেই দিন তাঁর অভিনয়ে খুশী হয়ে এক দর্শক তাঁকে ৫ টাকা পুরস্কার দেন, যা তাঁর জীবনের সেরা পুরস্কার বলে মনে করেন তিনি।
রনজিত মল্লিক এর অভিনিত উল্ল্যেখযোগ্য কয়েকটি যাত্রা পালা হলো, মানিকমালা, গরীবের মেয়ে, রাজসিংহাসন , রাঙা তলোয়ার, গৌরি মালা, জীবন্ত কবর, আলোমতি প্রেম কুমার। এইছাড়া তিনি আরোও অনেক যাত্রাপালা, থিয়েটার নাটক এবং পথ নাটকে অভিনয় করেছেন । তবে যাত্রা পালায় তিনি সবসময় রাজার চরিত্রে অভিনয় করতেন বলে জানান।
টেলিভিশন পর্দায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। বেসরকারি চ্যানেল এনটিভিতে প্রচারিত ” একটি কিনলে একটি ফ্রি” নামক টেলিফ্লিমে তিনি একটি চরিত্রে অংশ নিয়েছেন। যাত্রাপালার পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় পৌরানিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত নিমাই সন্নাস, সাবিত্রি সত্যবান সহ কয়েকটি পৌরাণিক নাটকে তিনি কখনো গায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, তারঁ গানের গলাও বেশ সুমধুর।
দ্যা লেপ্রুসি মিশনের প্রযোজনায় বিশিষ্ট অভিনেতা জন অশোক বাড়ৈ এর পরিচালনায় কুষ্ঠ বিষয়ক পথ নাটক “আকাশ কুসুম” নাটকে পাগল চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন তিনি । যা দুই শতাধিক মঞ্চস্থ হয়েছে। রাঙামাটির কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী, কাউখালী উপজেলা এবং চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, বোয়ালখালি সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়েও যাত্রা ও অভিনয় করেছেন এই গুণী অভিনেতা।
অভিনেতা রনজিত মল্লিক অভিনয়ের শিক্ষা জীবনে প্রয়াত বিশিষ্ট অভিনেতা বিভূতী রঞ্জন বড়ুয়া, শেখ মতিউর রহমান, আপ্রুসী কারবারী, জন অশোক বাড়ৈ, , গোপাল ব্যানার্জী সহ অনেক গুণী পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন।
অভিনয়ের পাশাপাশি রনজিত মল্লিক কাপ্তাই চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলী পেপার মিলস হাসপাতালে দীর্ঘদিন চাকুরি করেছেন। তিনি গত ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি থেকে অবসরে যান। অভিনেতা রনজিত মল্লিক অভিনয়ের সাথে সাথে একজন পাল্টা কীর্ত্তনীয়া ও সংগীতশিল্পী হিসেবেও জনপ্রিয়তা আছে। এছাড়া তিনি নিজেও বেশ কয়েকটি যাত্রায় পরিচালকের ভূমিকা পালন করেছেন বলে জানান। অভিনেতা রনজিত মল্লিক অভিনয়ে স্বীকৃতি স্বরূপ কাপ্তাই শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা, কেপিএম ম্যানেজমেন্ট থেকেও সংবর্ধনা পেয়েছেন।
কেমন কাটছে এই অভিনেতার বর্তমান জীবন এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একসময় অভিনয় করে জীবনে প্রথম তিনি ৫ টাকা সম্মানী পেয়েছিলেন। এরপর থেকে নামমাত্র সম্মানী কিংবা সম্মানী ছাড়াও ভালবেসে তিনি সারাজীবন অভিনয় করে গেছেন বলে জানান। টাকার জন্য নয়, বরং ভালবেসে অভিনয়কে আকঁঁড়ে ধরেছেন বলে জানান। বর্তমান সময়ে নাটক করে শিল্পীরা অনেক টাকা আয় করলেও তারা এমন সুযোগটা পাইনি বলে জানান। তবুও ভালবাসে, কোনরকমে অভিনয়কে ধরে রেখেছিলেন। অভিনয় ছিলো একমাত্র তাঁর ভালবাসা। এদিকে বর্তমানে দুর্বীষহ জীবন কাটছে তাঁর। বার্ধক্য জনিত সমস্যার কারনে তিনি চলাফেরা করতে এবং স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারেন না। তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, যদি সুস্থ থাকি, তাহলে মৃত্যুর আগে আর একটি বার মঞ্চে অভিনয় করবো।
ভবিষ্যৎ এ যেন সকলের ভালবাসা ও আর্শীবাদ নিয়ে বাকী জীবনটা পার করতে পারেন সেই আশা রাখেন তিনি।
অভিনেতা রনজিৎ মল্লিক এর পুত্র বাউল শিল্পী বসুদেব মল্লিক জানান, আমার বাবা আমাদের আদর্শ। বাবার হাত ধরে আমরা গান বাজনা শিখেছি।
কাপ্তাইযের এই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা ও পরিচালক এবং কাপ্তাই উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির নাটক বিভাগের প্রধান আনিছুর রহমান জানান, অভিনেতা রনজিৎ মল্লিক হলো আমাদের প্রেরণার উৎস। তাঁদের দেখা পথ ধরেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি রাজার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করতেন।