অভিমত সংসদে প্রতিনিধিত্বসহ ফিরিয়ে দেওয়া হোক প্রবাসীদের ভোটাধিকার

নিজস্ব প্রতিবেদক

 

দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে যুগ যুগ ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন প্রবাসীরা। দেশের যেকোনো অর্থনৈতিক সংকটে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স যেন এক প্রতিরোধের ঢাল হয়ে কাজ করে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ ২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের সময়। পতিত সরকারের রেখে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রবাসীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। গণঅভ্যুত্থনের সময় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনে অংশ নেন প্রবাসীরা। একমাস রেমিট্যান্স বন্ধ রেখে তারা সংকটাপন্ন সরকারকে বড় ধরনের চাপের মুখে ফেলেছিলেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই প্রবাসীরাই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। এর অন্যতম প্রমাণ— স্বাধীনতার পর পেরিয়ে গেছে ৫৪ বছর, অথচ এখনও প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়নি বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক বিপুলসংখ্যক প্রবাসী ভোটার রয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে প্রবাসীদের ভোটাধিকার কার্যকরের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে। নির্বাচন কমিশন ও সরকারের এ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা। তবে শুধু ভোটাধিকার নয়, জাতীয় সংসদে প্রবাসীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার দাবি তাদের। সংস্কার কমিশন প্রবাসীদের ভোটাধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় এনেছে। সরকারও সে বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। আগামী নির্বাচনে যদি অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী তালিকায় প্রবাসীদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়, তবে এই দাবিও পূরণ হওয়া সম্ভব। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, বিদেশে কর্মরত নিবন্ধিত বাংলাদেশির সংখ্যা ১ কোটি ৪৮ লাখ। যদিও অনানুষ্ঠানিকভাবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। অথচ এই বিশাল জনগোষ্ঠী, যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান, তাদের প্রকৃত সংখ্যা বা অবদান সম্পর্কেও নেই কোনো সুস্পষ্ট রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান! প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন, দেশে বর্তমানে মোট ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৩৭ লাখ ৩২ হাজার ২৭৪। এর বিপরীতে প্রায় ২ কোটি প্রবাসী ভোটার দেশের বাইরে থাকলেও জাতীয় অর্থনীতিতে রেখে চলেছেন সরাসরি প্রভাব। অথচ তারা বছরের পর বছর ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়সঙ্গত সমাজব্যবস্থার অন্যতম অনুষঙ্গ। শুধু অর্থনৈতিক অবদান নয়, নীতিনির্ধারণ প্রক্রাতেও প্রবাসীদের অংশগ্রহণ জরুরি। তাদের ভোটের মাধ্যমে এমন প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হতে পারেন, যারা প্রবাসীদের স্বার্থ তুলে ধরবেন সংসদে। বিশ্বের বহু দেশেই প্রবাসীরা নিজ নিজ দেশের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান। সেদিক থেকে বাংলাদেশে এখনও এই অধিকার কার্যকর না হওয়া বৈষম্যের শামিল। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটেও বলা হয়েছে, বহু প্রত্যাশিত হলেও প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটদান এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে একমাত্র অনুমোদিত পদ্ধতি— পোস্টাল ব্যালট কার্যত অকার্যকর হয়ে আছে। সময়সীমা ও বাস্তব জটিলতার কারণে এই পদ্ধতিতে কার্যকরভাবে কোনো ভোটগ্রহণ সম্ভব হয়নি। ২০২৪ সালের বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রবাসীদের ভোটাধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনও এই বিষয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রবাসীদের ভোট গ্রহণের জন্য তিনটি পদ্ধতি প্রস্তাব করেছে—১. তথ্যপ্রযুক্তি সহায়তাসহ পোস্টাল ব্যালট ২. অনলাইন ভোটিং৩. প্রক্সি ভোটিং এই প্রস্তাবনার আলোকে গত ৮ এপ্রিল একটি ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়, মন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বেসিস ও সফটওয়্যার কোম্পানির প্রতিনিধিরা অংশ নেন। একই ধারাবাহিকতায় ২৯ এপ্রিল ‘প্রবাসী ভোটারদের জন্য ভোটিং সিস্টেম উন্নয়ন’ শীর্ষক সেমিনার নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, গণমাধ্যমের সম্পাদক, সুশীল সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তবে এখনও পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদ্ধতি চূড়ান্ত হয়নি। তাই এখনই যদি অন্তর্বর্তী সরকার প্রবাসীদের ভোটাধিকার বাস্তবায়নে সিদ্ধান্ত না নেয়, তাহলে এটি হয়তো আর কখনোই আলোর মুখ দেখবে না।

আবুল কালাম আজাদঃ
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও কলাম লেখক

সোস্যাল নেটওয়ার্ক

সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত