সকালে চারদিকে “গো’লাগু’লি ও বিকট বিস্ফো’রণের মধ্যেই নানা নাট’কীয়তা” আর টান টান উত্তে’জনায় বাংলাদেশ মোশারফ হোসেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

 

বিশেষ প্রতিবেদকঃ

কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, মগবাজার, মৌচাক, শান্তিনগর, পল্টন, বঙ্গভবন, প্রেস ক্লাব, মৎস ভবন হয়ে সেনা-পুলিশের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী ডিঙিয়ে গণ-অভ্যূত্থানের কেন্দ্রস্থল শাহবাগ মোড়ে আমরাই প্রথম ঢুকে পড়ি ৩৬ জুলাই ২০২৪ (৫ আগস্ট): ২০২৪-এর ৫ আগস্ট তার কয়েক ঘন্টা পরই শেখ হাসিনার পদত্যাগের গুঞ্জন, এবং শাহবাগের দিকে লাখ লাখ ছাত্র-জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার। অতপর গণভবন, সংসদ ভবন, শহীদ মিনার, ধানমন্ডি-৩২ এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়…ঐতিহাসিক গণ-অভ্যূ’ত্থানে ফ্যাসি’বাদের প’তন: ২০২৪-এর ৩ জুলাই শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয় ৩ আগস্ট। ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের ডাকা ‘সর্বাত্মক অসহযোগে’ নজিরবিহীন সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা তাঁদের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করে। আর এতেই যেন ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায় বিগত সরকার ও সরকার প্রধানের। জনরো’ষ আর তির’স্কার ও ঘৃ’ণা সঙ্গী করে, হাজারো শহি’দের র’ক্ত মাড়িয়ে ৫ আগস্ট পদত্যাগের পর দুপুর আড়াইটার দিকে একটি সামরিক বিমানে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা। তাঁদের বহনকারী সামরিক বিমানটি যখন ভারতের উদ্দেশে ছেড়ে যায়, তখন পেছনে পড়ে থাকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ব্যাপক সং’ঘাত-সহিং’সতা, লা’শের স্তূপ আর নিপী’ড়িতের হাহা’কার। একদিকে ছিল বিজয় মিছিল, অন্যদিকে নৃশংসতা। শেখ হাসিনার দেশছাড়ার পরও যাত্রাবাড়ী ও আশুলিয়াতে চলে গণহ’ত্যা। ভাইয়ের মরদেহের সুরতহাল বাদ দিয়ে বুলেটে বিদীর্ণ বুক নিয়ে, কদমে কদমে কাঁটাতার, তাজা র’ক্ত, দমবন্ধ টিয়ারগ্যাস মাড়িয়ে গণভবনের কয়েক গজে যখন মুক্তিকামীরা, সূর্য তখন মগজে। বিদ্রো’হ রূপ নিলো বিজয়ে। গণভবন, সংসদ ভবন, রাজপথে তখন লাখো মানুষের ঢল। টানা দেড় যুগে নির্যাতিতদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে মুহূর্তেই। একদিকে বিজয় উল্লাস, ঠিক তার উল্টো পিঠে রাজধানীর দুই প্রবেশমুখ সাভার, আশুলিয়া ও যাত্রাবাড়ীতে চলে নৃশং’সতা। সকাল থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত কয়েকজন নিহত হলেও বড় সহিং’সতা ঘটে তারপর। নিরস্ত্র অনেকেই আকুতি জানিয়েও শেষ রক্ষা পাননি। আধা ঘণ্টা পর গলি আর ফুটপাত পরিণত হয় তাজা মর’দেহের স্তূপে। অন্যপ্রান্ত সাভার, আশুলিয়ায় রাত পর্যন্ত শুধু গু’লিবর্ষণ আর হ’ত্যা-ই হয়নি। ৬ জনের মরদেহ পুড়িয়ে দেয়ার মতো নৃশং’সতার সাক্ষীও হয় দেশ। এর আগে, কারফিউ ভাঙতে বিচ্ছিন্নভাবে হ’ত্যাযজ্ঞ চলে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে। চানখারপুলের সকাল ছিল বেশি বিভৎস। নিকট দূরত্ব থেকে নগ্ন হামলা চলে সেখানে। এমন তাজা র’ক্ত, মগজ দিয়ে আজন্ম প’ঙ্গুত্ব বরণ করে নিয়ে ক্ষমতা মাড়িয়ে যে বিজয়, সেটিই ৩৬ জুলাই! এর আগে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ডাকা ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ বা ঢাকামুখী গণযাত্রা সফল করতে কারফিউ অমান্য করে রাজধানীর রাস্তায় নেমে আসে লাখো মানুষ। ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশপথ দিয়ে মানুষ আসতে থাকে। সকাল ১০টার পর থেকে যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, শহীদ মিনার, বাড্ডা, মিরপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভকারীদের জমায়েতের খবর আসতে শুরু করে। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অবস্থান নিলেও রোধ করা যায়নি ঢাকামুখী জনস্রোত। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও হয়। দুপুর নাগাদ অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায়, নড়ে যাচ্ছে সরকার। দুপুর সোয়া ১টার দিকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন। তখনই মানুষ বুঝে যায়, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ঘর থেকে বের হতে শুরু করে মানুষ। শেখ হাসিনার পদত্যাগের কথা জানাজানি হয়ে যায়। রাজপথ ভরে ওঠে লাখো জনতায়। রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষ বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে। একপর্যায়ে বিকেলের দিকে জনস্রোত গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও জাতীয় সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে। বিজয়োল্লাসের পাশাপাশি এসব জায়গায় ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর বিকেলে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেন, ‘দেশে একটা ক্রান্তিকাল চলছে। সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ করেছিলাম। আলোচনায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, সব হত্যা, সব অন্যায়ের বিচার আমরা করব। আপনারা সেনাবাহিনীর প্রতি, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখুন।’ সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকিসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। পরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সভাপতিত্বে বঙ্গভবনে সিদ্ধান্ত হয়, অনতিবিলম্বে দেশে একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। বৈঠকে সেনাপ্রধান, নৌপ্রধান ও বিমানবাহিনীর প্রধান এবং দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা ছিলেন। এদিন রাত সোয়া ৯টায় একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সরকারের রূপরেখা দেওয়া হবে। ছাত্রজনতা, নাগরিকসমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি রূপরেখা জাতির সামনে উপস্থান করা হবে। ৩৬ জুলাইয়ের বিজয় কেবল অতীতের একটি ঘটনার স্মরণ নয়—এটি ভবিষ্যতের রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তি, যেখানে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধ ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এই অভ্যুত্থান ছিল জাতীয় ঐক্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন—যেখানে ছাত্র, শ্রমিক, পেশাজীবী, প্রবাসী, সাংবাদিক, শিল্পী ও রাজনৈতিক দলসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ একত্রে দাঁড়িয়েছিল রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে। সেই ঐক্য এখন আরও প্রয়োজন—রাষ্ট্রকে নতুন ভিত্তিতে নির্মাণ করতে হলে সবাইকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে।

সোস্যাল নেটওয়ার্ক

সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত