
আহমদ বিলাল খানঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণের ইস্যুকে সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় তিব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ (পিসিসিপি)। বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) সকালে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে এই নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন পিসিসিপি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন কায়েস ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ হাবীব আজম। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি বহু-জাতিগোষ্ঠীর আবাসভূমি। এখানে বাঙালি ও বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে পাশাপাশি বসবাস করছে। এই মিশ্র সমাজে অপরাধ ঘটবে, এটা স্বাভাবিক সামাজিক বাস্তবতা। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, যখন কোনো অপরাধ উপজাতি নারী ও বাঙালি পুরুষকে ঘিরে ঘটে, তখন ঘটনাটি বিচার বা প্রমাণের আগে জাতিগত উত্তেজনা সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। পিসিসিপি নেতৃবৃন্দ বিবৃতিতে পাঁচটি পয়েন্ট তুলে ধরেন—
১. অভিযোগ ও প্রতিক্রিয়ার বৈষম্য ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ— এটি জাতি, ধর্ম বা গোষ্ঠীভেদে ভিন্ন নয়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে দেখা যায়, যখন কোনো উপজাতি নারী কোনো বাঙালি পুরুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে, তখন সঙ্গে সঙ্গে কিছু উপজাতি রাজনৈতিক সংগঠন (যেমন: জেএসএস, ইউপিডিএফ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, জুম্ম ছাত্র জনতা) রাজপথে নামে। এছাড়াও কিছু সুশীল নামধারী উগ্রসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি যেমন ইয়েন ইয়েন, মাইকেল চাকমা, পল্বব চাকমা, ডা মংসানু মারমা, দেবাশীষ রায় সহ আরো বেশ কিছু ব্যক্তি উস্কানি দিয়ে পাহাড়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। ঘটনার তদন্ত বা প্রমাণ উপস্থাপনের আগেই “জাতিগত নিপীড়ন”, “উপজাতি নারী নির্যাতন”, “বাঙালি কর্তৃক দমননীতি” “পাহাড় থেকে সেনা হটাও” ইত্যাদি স্লোগানে প্রচারণা চালানো হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার কাছেও বিষয়টি বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়। অন্যদিকে, যখন কোনো উপজাতি নারী নিজ উপজাতি পুরুষের হাতে ধর্ষিত হয়, তখন সেসব সংগঠন নীরব থাকে। কোনো মানববন্ধন হয় না, কোনো প্রতিবাদ দেখা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় উপজাতি সমাজ নিজস্ব তথাকথিত “প্রথাগত নিয়মে” টাকার বিনিময়ে ও শুকর জরিমানা করে “মীমাংসা” করে ফেলে। ফলে প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি হয় না, এবং ভুক্তভোগী নারীও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। ২. তথ্য ও বাস্তবতা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়- গত এক দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের প্রায় অর্ধেক ঘটনাই উপজাতি সমাজের অভ্যন্তরে সংঘটিত, কিন্তু এর মাত্র সামান্য অংশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়। বহু ক্ষেত্রে পরিবার বা গোষ্ঠীপ্রধানরা “প্রথাগত বিচার”এর নামে আইন আদালতে মামলা করতে বাধা দেন। এমনকি কিছু মানবাধিকার সংগঠনও বাছাই করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে— উপজাতি বনাম উপজাতি ঘটনার প্রতি তাদের আগ্রহ থাকে না। তথ্যসূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ (২০২২), বাংলাদেশ প্রতিদিন (২০২১), মানবাধিকার কমিশনের আঞ্চলিক প্রতিবেদন (২০১৯) এই সূত্রগুলোতে উল্লেখ আছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০১৫–২০২১ সাল পর্যন্ত অন্তত ৩৫টির ও বেশি উপজাতি-উপজাতি ধর্ষণের ঘটনা স্থানীয় পর্যায়ে “মীমাংসা” করা হয়, যা আদালত পর্যন্ত যায়নি। ৩. রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও জাতিগত বিভাজন এই ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার মূল কারণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। চরমপন্থী উপজাতি সংগঠনগুলো চায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে “জাতিগত নির্যাতনের অঞ্চল” হিসেবে উপস্থাপন করতে, যাতে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি পাওয়া যায় এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে শক্তিশালী করা যায়।
তারা জানে, উপজাতি বনাম উপজাতি ধর্ষণের ঘটনায় এমন প্রচার সম্ভব নয়। তাই বাঙালি অভিযুক্ত থাকলে বিষয়টি “রাজনৈতিক হাতিয়ার” হয়ে যায়। অনেক সময় বাঙালিরা জড়িত না থাকলেও মিথ্যা অভিযোগ তুলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ৪. আইনি ও নৈতিক দিক বাংলাদেশের সংবিধান ও দণ্ডবিধি অনুসারে, ধর্ষণ একটি জাতিহীন অপরাধ — অপরাধী ও ভুক্তভোগীর জাতিগত পরিচয় নয়, প্রমাণই মুখ্য। কিন্তু পাহাড়ে কিছু সংগঠন আইনকে পাশ কাটিয়ে জনতার বিচারের নামে মব সৃষ্টি করে সহিংসতা চালায়— যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী এবং রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধও বটে। ৫. সমাধান কী? ক: প্রত্যেক ধর্ষণ মামলা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করা। খ: অপরাধকে জাতিগত বা রাজনৈতিক ইস্যু বানানো বন্ধ করতে হবে। গ: মিডিয়া ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে বাছাই নয়, বরং সব ঘটনার ন্যায়সঙ্গত প্রতিবেদন দিতে হবে। ঘ: ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনিক নজরদারি ও রাষ্ট্রীয় উপস্থিতি আরও শক্ত করতে হবে। পরিশেষে পিসিসিপি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বিবৃতিতে বলেন, কদিন আগে খাগড়াছড়িতে মিথ্যা ধর্ষণের ইস্যুতে সহিংসতা ছড়িয়ে দিয়ে সেনাবাহিনীর উপর ও বাঙালিদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা করে পুরো খাগড়াছড়ি জুড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হলো, কিন্তু রাঙামাটির কাপ্তাই ও খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় সাম্প্রতিক সময়ে দুটি গণধর্ষণের ঘটনায় পাহাড়ের তথাকথিত আন্দোলনকারী ও অধিকার কর্মীরা চুপ।
পিসিসিপি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ প্রশ্ন রেখে বলেন,
পাহাড়ের দুই জেলার ধর্ষণের ঘটনায় এখন কি কোন প্রতিবাদ হবে না? নাকি শুধু বিশেষ ক্ষেত্রে ধর্ষণের ইস্যু সামনে এনে সহিংসতা ছড়িয়ে বিশেষ ফায়দা লুটতে প্রতিবাদের নামে নৈরাজ্য করে পাহাড়ি উপজাতি আঞ্চলিক সংগঠন গুলো। ধষর্ণের মত সংবেদনশীল বিষয়কে সাম্প্রদায়িক ইস্যু তৈরী করে বার বার পাহাড়কে অস্থিতিশীল করে তুলে যারা, অথচ প্রকৃত অর্থে ধর্ষণের বিরুদ্ধে তাদের কোন প্রতিবাদ নেই। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ নয়, তারা মূলত প্রতিবাদের নামে সহিংসতা ছড়িয়ে পাহাড়কে অস্থিতিশীল করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বিশেষ ক্ষেত্রে ধর্ষণের ইস্যু। এদিকে রাঙামাটির কাপ্তাইে প্রতিবন্ধী মারমা কিশোরীকে ধর্ষণ করে পাঁচ মাসের আন্ত:সত্ত্বা করেছে উপজাতি তিন মারমা যুবক, ও গত ২০ অক্টোবর খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় এক উপজাতি নারী মন্দিরে গেলে সেখানে জোর পূর্বক চার ত্রিপুরা উপজাতি যুবক গণধর্ষণ করে। কিন্তু কদিন আগে খাগড়াছড়িতে যারা মিথ্যা ধর্ষণের ইস্যুতে গলা ফাটালো তাদের এখন সকলের গলা চুপ হয়ে রইলো কেন?
কি জবাব দিবে তারা? ধর্ষণকে আর কত রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক হাতিয়ার বানাবে পাহাড়ের আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন গুলো ও তথাকথিত অধিকার কর্মীরা? পাহাড়ে এই ধর্ষণের ইস্যুতে যারা সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের সকলকে সামাজিক ভাবে বয়কট করতে ও আইনের আওতায় আনার দাবিতে সোচ্চার হতে আহ্বান জানান পিসিসিপির নেতৃবৃন্দরা। পিসিসিপি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরা আরো বলেন, ধর্ষণ একটি সামাজিক অপরাধ, কোনো জাতিগত সংঘাত নয়। বাঙালি অপরাধী হলে যেমন বিচার চাই, উপজাতি অপরাধী হলেও একইভাবে বিচার চাই—এটাই ন্যায়বিচারের মানদণ্ড। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে এই নৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে, আর এর সুযোগ নিচ্ছে পাহাড়ের কিছু স্বার্থান্বেষী আঞ্চলিক রাজনৈতিক গোষ্ঠী। এখন সময় এসেছে—“ধর্ষণ নয়, অপরাধীর বিচার”—এই একমাত্র নীতি মেনে চলার।