চৌধুরী মুহাম্মাদ রিপনঃ
সরকার দূর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স কথা বলে আসলেও কিছু অসাধু কর্মকর্তা র কাছে বন্দি হয়ে আছে দূর্নীতি। নীতিমালা অনুযায়ী সফটওয়ারের মাধ্যমে অনলাইন এবং হার্ট কপি যাচাই বাছাই করে যোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এমপিওভুক্তি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো সরকার। সাড়ে নয় বছর পর গত ২৩ অক্টোবর ২৭৩০টি নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তালিকা প্রকাশের পর দেখা গেলো এমন কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম এমপিও ভূক্ত করা হয়েছে যা দেখে `আকাশ থেকে পড়া`র মতো অবস্থা । মাঠ লেভেল থেকে অনেকেই এ তালিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তালিকায় অস্তিত্বহীন টেকনিক্যাল কলেজ, সরকারি কলেজ এবং বিএনপি-জামায়াত-শিবির ও যুদ্ধাপরাধী মামলার আসামি প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হলেও সরকারদলীয় মন্ত্রী-এমপিদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও ভূক্ত হয়নি। এমন কী এমপিওভুক্তির কার্যক্রমে এমপিদের দেয়া ‘ডিও’ লেটারও আমলে নেয়া হয়নি। এতে সরকারদলীয় মন্ত্রী-এমপিরাও ক্ষুব্ধ।
গত বুধবার সন্ধ্যায় প্রকাশিত নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির তালিকা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে। এতে বাদ পড়ে রাঙ্গামাটি কাপ্তাই উপজেলা কর্ণফুলী পেপার মিল এলাকার ৩৫ বছর পূর্বে কে আর সি হাই স্কুল, রাঙ্গামাটি থেকে নির্বাচিত দীপঙ্কর তালুকদার এমপি বার বার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসে ঘোষণা করেন রাঙ্গামাটিতে কোন স্কুল কলেজ এমপিও হলে কে আর সি হাই স্কুল এমপিও ভূক্ত হবে। তিনি স্কুলের তিন তলা বিশিষ্ট ক্লাস রুম করা বিভিন্ন সহযোগিতা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সরকার দলীয় এমপি হিসেবে ডিও লেটার ও দিয়েছেন যাতে কে আর সি হাই স্কুল এমপিও ভূক্ত হয়। এতো কিছু করার পরও দূর্নীতি কারণে কে আর সি হাই স্কুল এমপিও ভূক্ত হয়নি। এই ভাবে আরো অসংখ্য স্কুল কলেজ শর্ত পূর্ণ করার পরও এমপিও ভূক্ত হতে বঞ্চিত। নোয়াখালীর কবিরহাটে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বাবার নামে ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মোশাররফ হোসেন মাধ্যমিক হাইস্কুল ও টাঙ্গাইলের ধনবাড়িতে কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত রেজিয়া কলেজ। সাবেক সমাজকল্যান মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ প্রতিষ্ঠিত এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া যে কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন ও বর্তমান বেসমারিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট মো.মাহবুব আলী এমপির প্রতিশ্রুতি দেয়া হবিগঞ্জের মাধবপুরের চৌমুহনী খুর্শিদ হাইস্কুল এন্ড কলেজটিও এমপিওভুক্ত হয়নি । নীতিমালার সব শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজটি এমপিও হয়নি। এমনকি এমপিওভুক্তির দাবিতে যেসব শিক্ষক আন্দোলন করেছিলেন তাদের সংগঠনের সভাপতি ও সম্পাদকের প্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্ত হয়নি। তবে ভোলার সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের মা, বাবা, স্ত্রী ও নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত চারটি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে। জামালপুর সদর উপজেলায় প্রায় ১৮টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে। এদিকে, ১০ বছর আগে পঞ্চগড়ের বোদায় ঝলইশালশিড়ি ইউনিয়নের নতুন হাট টেকনিক্যাল এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপতি হলেও অনেক আগেই বিলীন হয়েছে সেটির অস্তিত্ব। জায়গাটি বর্তমানে পরিত্যক্ত। তবু এমপিওভুক্ত হয়েছে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানটি। এমপিওভুক্তির তালিকায় সরকারি কলেজ : হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার শাহজালাল কলেজকে সরকারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ গত বছরের ১২ আগস্ট আদেশ জারি করে। ওইদিনের আদেশে বলা হয়েছিল, ‘সরকারিকৃত কলেজ শিক্ষক ও কর্মচারী আত্মীকরণ বিধিমালা-২০১৮’ এর আলোকে জেলা ও উপজেলাধীন ২৭১টি কলেজ ৮ আগস্ট থেকে সরকারি করা হলো।’ সেই ২৭১ কলেজের মধ্যে একটি হলো শাহজালাল কলেজ। গত বুধবার প্রকাশিত এমপিওভুক্তির তালিকায় দেখা যায়, তালিকার ৫১ নম্বরে (ইআইএন ১২৯৪৯২) থাকা শাহজালাল কলেজটির ডিগ্রি স্তরের এমপিওভুক্তি হয়েছে। এ ব্যাপারে শাহজালাল কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক বলেছেন, সরকারি হওয়ার পরও আমাদের কলেজের ডিগ্রি শাখা এমপিওভুক্তির তালিকায় যুক্ত হলো কিভাবে। তারা হয়তো ঠিকভাবে তথ্য যাচাইবাছাই করেননি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেছেন, এমপিও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত সরকারি কলেজটি বাদ দেয়া হবে। বিএনপি-জামায়াত কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান হলেও যোগ্যতার কারণে অনেকে এমপিও পেয়েছে। মন্ত্রীদের বাবা-মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান এমপিও না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, কার কী বাদ গেল এই নীতিমালায় তা দেখার সুযোগ নেই।
বিএনপি-জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধীদের নামে ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত : অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার সোনাকান্দা ড. মোশাররফ হোসেন ইসলামিয়া রহমানিয়া দাখিল মাদ্রাসা, দাউদকান্দি উপজেলার ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন হাইস্কুল, ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার শহীদ জিয়া ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসা , বগুড়া গাবতলীর শহীদ জিয়াউর রগমান গার্লস হাইস্কুল, সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার এম সাইফুর রহমান টেকনিক্যাল এন্ড বিএম কলেজ, সাতক্ষীরার তালার শহীদ জিয়াউর রহমান মহাবিদ্যালয়, ঝালকাঠির নলছিটির প্যালেস্টাইন টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ ও বগুড়ার গাবতলীর শহীদ জিয়াউর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের হিলফুল ফুজুল টেকনিক্যাল ও বিএম কলেজ ও ঝিনাইদহের মশিউর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত হয়েছে। পঞ্চগড়ের সদর উপজেলার চাকলাহাট ইউনিয়নের বাসিন্দ ’৭১-এর শান্তি কমিটির সদস্য খামির উদ্দিন প্রধানের নামে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাটির আলিম স্তর এবার এমপিওভুক্ত হয়েছে। এতে এলাকায় ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। নেত্রকোনার কমলাকান্দার হিলফুল ফুজুল জামায়াত ইসলামি এনজিও হিসেবে পরিচিত। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ১২৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ প্রতিষ্ঠানটিও এমপিওভুক্ত হয়েছে। ঝালকাঠির নলছিটির প্যালেস্টাইন টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এলাকার সুলতান আহমেদ। তিনি জামায়াতপন্থি প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামির নামে এমপিওভুক্ত হলো হাইস্কুল : সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলায় যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি আলহাজ ঝুনু মিয়ার নামে নামকরণকৃত আলহাজ ঝুনু মিয়া হাইস্কুলের নিম্ন মাধ্যমিক স্তর এমপিওভুক্ত হয়েছে। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন। ২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ঝুনু মিয়ার নামে জামালগঞ্জ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সদরকান্দি গ্রামের আবদুল জলিল একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ঝুনু মিয়াসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এই মামলাটি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্তের জন্য পাঠিয়েছিলেন আদালত। মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ঝুনু মিয়ার বাবা লাল মিয়া ছিলেন হাওরাঞ্চলের শীর্ষ রাজাকার। নিজের নামে প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হওয়ায় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন রতনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ঝুনু মিয়া। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সদস্য আকবর হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার রাজাকারের নামে প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি দেয়াটা আমাদের জন্য কষ্টের। জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২) মো. জাবেদ আহমেদ বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি যাতে কোনো যুদ্ধাপরাধী কিংবা এ সংক্রান্ত মামলার আসামির নামে প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রতিষ্ঠান যাতে এমপিও না পায়। কিন্তু সব যুদ্ধাপরাধীকে আমরা চিনি না। একারণে হয়ত একটা-দুটো প্রতিষ্ঠান শর্তের মধ্যে পড়ে এমপিওভুক্ত হয়ে গেছে। সকলের দাবী সরকারের কাছে এমপিও ভূক্ত করণ পূর্ণবিবেচনা করার।