ঐতিহ্যমন্ডিত রত্নগর্ভা কক্সবাজারের চকরিয়ার যুব সমাজের স্বদেশ চেতনা বিশ্ববোধ ও ঐতিহ্য মনস্ক দৃষ্টভঙ্গির আগ্রহ সঞ্চার এবং মন মানসে নৈতিক মূল্যবাধ ও মানবিক গুনাবলীর অন্যতম দাবীদার অভিবক্ত চকরিয়া।স্বাধীন বাংলাদেশের মহৎ কাজগুলো কল্যাণকর উদ্দেশ্যে সাধিত হয়েছে এবং এতে কোন অর্থের প্রাচুর্য্যেতায় নয় বরং শ্রম সাধনায় অনস্বীকার্য পাথেয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকৃত চকরিয়ার দামাল সূর্যসন্তানদের স্বতঃস্ফুর্ত যুদ্ধের ভূমিকায়।
ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের “পলিমাটির সৌরভের” এই ভূ-খন্ডে,ইতিহাসের কোন লগ্নটিতে আমাদের জাতীয়তা বোধের উন্মেষ ঘটেছিল, তা নিরূপণ দুরহ।স্বাধীনতার বেদনাবোধের উৎস রয়েছে মানুষের অনুভূতির সুগভীরে।এই ভূখন্ডের মানুষের হাজার বছরের ইতিহাসের তাদের জাতীয়তা বোধের চেতনাকে সঞ্জিবিত করেছে ইতিহাসের বিভিন্ন লগ্নে স্রোতধারা।হাজার বছরের ইতিহাসের চড়াই উতরায়ে আহৃত অভিজ্ঞতা আর অনুভূতিতে দানা বাঁধা আমাদের জাতীয়তাবোধকে আলোকিত করেছে অতীশ দীপঙ্করের জ্ঞানের প্রদীপ, মধুর করেছে চন্ডীদাসের আওয়ালের গান ও কবিতা,অটল করেছে হযরত শাহজালালের বিশ্বাস,উদ্বুদ্ধ করেছে রবীন্দ্রনাথ নজরুলের শতরূপে সাজানো জাদুকরী আমাদের বর্ণমালা।এসবের প্রেরণা সমুদ্রের মতই উত্তাল উদ্দামে এগিয়ে নিয়ে গেছে আমাদের প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রাম।শুধুই কি স্বাধীনতার সংগ্রামে সীমাবদ্ধ ছিল চকরিয়া? কিন্তুু না ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে চকরিয়াবাসীর ভূমিকা ছিল স্বতঃস্ফুর্ত ও কার্যকরি।
যার স্বাক্ষ্য বহন করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা কমরেড সুরেশচন্দ্রের সাথে মাষ্টারদা সূর্যসেন,রামকৃষ্ণ বিশ্বাস,তারেকেশ্বর, সুকেন্দু দত্তসহ বহু বিপ্লবী নেতা চকরিয়ায় আত্নগোপন করেছিলেন এবং চকরিয়া থেকে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করতেন। ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে ৭ই মার্চ রেসকোর্সের আহ্বান এবং ২৬শে মার্চের কালুরঘাটের আহ্বানে মাতৃভূমি রক্ষার তাগিদে চকরিয়াবাসী থেমে থাকেনি।অন্যান্য আন্দোলনের মত স্বাধীনতা সংগ্রামে চকরিয়া বাসীর অংশগ্রহন স্বাধীনতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।১৯৭১ সালের ১০ই মার্চ দেশপ্রেমিক চকরিয়া বাসীর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ সুগম করার লক্ষে “স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ” এবং “স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম চকরিয়া থানা “গঠন করে। তথ্য উপাত্ত অনুসারে যতটুকু জানা যায় সর্বপ্রথম এস কে শামসুল হুদাকে সভাপতি এবং প্রাক্তন জাতীয় সংসদ সদস্য ডা.শামসুদ্দিন চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মন্ডিত করে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের কার্যকরি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যে তিনজন ব্যাক্তি সংগ্রাম পরিষদের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন তারা হচ্ছে আলহাজ্ব আনোয়র হোসেন, শামসুল হুদা বি এস সি,হাজী আবু তাহের।মফজল আহমদ ও মাষ্টার আব্দুল মালেক কোষাদক্ষ ও সহ- কোষাদক্ষ নির্বাচিত হয়েছিলেন। জমির উদ্দীন সাংগঠনিক ও তাহের আহমদ দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতঃপর আনোয়ারুল ইসলাম বাবু মিয়,মাষ্টার আব্দুল মালেক,মফজল আহমদ,মোজাম্মেল হক বি এ,অধ্যাপক মমতাজ আহমদ চৌধুরী,আনোয়ার হোসেন বাঙ্গালী,হাবিলদার গোলাম কাদের, হাবিলদার আবুল কালাম, মৌলানা নজির আহমদ,হাজী বশিরুল আলম প্রমুখ সংগ্রাম পরিষদের তত্তাবধানে ছিলেন।সংগ্রাম কমিটি গঠনের অব্যবহিত পরে আনোয়ারুল হাকিম দুলালকে আহ্বায়ক করে সিরাজুল হক,এনামুল হক, সাহাবুদ্দিন, রেজাউল করিম চৌধুরী,খায়রুল আলম,আনোয়ার হোসাইন,শিব্বির আহমদ,গিয়াস উদ্দিন,আবু তাহের এবং শামসুল আলমকে সদস্য করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।এই কমিটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন এ এইচ এম সালাহ্উদ্দিন মাহমুদ, নুরুল আবচার এবং নাছির উদ্দিন।১০ই মার্চ থেকে ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষনার পূর্বদিন পর্যন্ত প্রায় ২ হাজারের অধিক লোক চকরিয়ায় প্রশিক্ষণ শিবির থেকে ট্রেনিং গ্রহণ করেছিল বলে জানা যায়।
২৩শে মার্চ চকরিয়া বিমান বন্দরের সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।প্রবীনদের ভাষ্যমতে তখনকার সময়ে দশহাজারের অধিক লোকের সমাগম হয়েছিল। মূলত জনসভার পর থেকে চকরিয়া বাসী স্বাধীনতা উত্তাল স্বপ্নের ব্যাকুল মদিরতায় আরো গভীর সংকল্পের ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে বলিয়ান হয়ে উঠে।স্বাধীন বাংলা বিনির্মাণেরর দীপ্ত শফথে অপ্রতিরুদ্ধ হয়ে উঠে তাদের মন ও মনন।সিপাহী এনামুল হক ২৫শে মার্চ কালো রাতে ১২জন বাঙালী সিপাহীসহ পাক বাহিনীর হাতে বন্দী হন।২৬শে মার্চ তাদেরকে হত্যা করার জন্য ট্রাকযোগে আগ্রাবাদ নিয়ে যাবার পথে সুকৌশলে ট্রাক ড্রাইভারকে হত্যা করে ট্রাকসহ সুদূর টেকনাফে চলে যান।কেরানী পাড়ার যুদ্ধে পাক বাহিনীর ঘাটি ধ্বংসের অভিযানের সময় সিপাহী এনামুল হক শহীদের মিছিলে শামিল হন।পালাকাটা গ্রামের শহীদ সিপাহী গোলাম কাদেরকে ৭১ এর ২৫শে মার্চ গভীর রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনা নিবাসে গুলি করে হত্যা করা হয়।চট্রগ্রাম বন্দরে ভারী অস্ত্্র নামানোর বিষয়ে অগ্নিঝরা প্রতিবাদকারীদের অন্যতম ছিলেন চকরিয়ার হারবাং ইউনিয়নের সন্তান শহীদ গোলাম সত্তার।২৮শে মার্চ সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্তে শহীদ হাবিলদার আবুল কালাম,নায়েক বদিউল আলম,নায়েক আশরাফ,হাবিলদার গোলাম কাদের,মোজাম্মেল হক,শামশুল হুদা,শের আলম,শাহনেওয়াজ,আনোয়ার হোসেন বাঙ্গাল,খলিলুর রহমান,আবুল কাশেম প্রমুখ যোদ্ধারা চকরিয়া থানায় এক সাহসী হামলা চালিয়ে ১১টি৩০৩ রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধাদের জন্য নিয়ে আসে, ৩০শে মার্চ চকরিয়া থেকে সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ৫ট্রাক খাদ্যশস্য চট্রগ্রাম রেস্ট হাউজ,পটিয়া, কালুরঘাট ও অন্য কয়েকটি এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযুদ্ধের জন্য সাহায্য হিসাবে পাঠানো হয়।১৮ই এপ্রিল মোজাম্মেল হক বিএ এর নেতৃত্বে আরেকদল মুক্তিবাহিনী একটি সাদা টয়োটা কারসহ চারজন সশস্ত্র লোককে গ্রেপ্তার করেন।এরমধ্য দুজনকেই চকরিয়ার মেইন বাস স্টেশনে চিরিংগায় গুলি করে হত্যা করা হয় এবং বাকী দুজনকেই ফাঁসিয়াখালী ঢালায় গুলিকরে আহত করা হয়।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলেও সত্য ২৭শে এপ্রিল হানাদার বাহিনী চকরিয়ার প্রতিরোধ বুহ্য ভেঙ্গে চকরিয়ায় প্রবেশ করে।
মহান বিজয় দিবস উদযাপনের লক্ষে দীর্ঘকাল থেকে বন্ধ থাকা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা অনুষ্ঠিত হেক তরুণ প্রজন্মের একটাই দাবী।
লেখক ও সাংবাদিক
মোঃ নাজমুল সাঈদ সোহেল