
চট্টগ্রাম কলেজ আমার নিকট আমার লিখা এক একটি প্রেমের কবিতার মত।যৌবনে প্রথমে কুমিল্লা সরকারী ভিক্টোরিয়া কলেজ এর পর চট্টগ্রাম কলেজের কয়েকটি বছর যা ভালবাসা,স্মৃতি,বেদনায় আমাকে কাঁদাবে আরও অনেক বছর।গত ২৬ তারিখ ভেবেছি গ্রামের বাড়ি যাব ও খেজুরের রস নিয়ে শহরে আসব। হঠাৎ মনে পড়ল ২৭ তারিখ জিইসি কনভেশনে চট্টগ্রাম কলেজের ১৫০ বছর পূর্তি। যে যাই বলুক শীতে খেজুরের রস ও পিঠা আমার খু্ব প্রিয়।শীতকালে খেজুর গাছ কেটে রস-সংগ্রহ করা মিরসরাই রাঘবপুর গ্রামের যেন এক চিরচেনা দৃশ্য। অামি নিজেই গ্রামের বাড়ীতে থাকা অবস্হায় খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করেছি অনেকবার। অন্য দিকে কবি সানাউল হকের কাছে খেজুরের রস নয়,গাছটার বেদনাটা কষ্টের তাই বোধের প্রকাশ ঘটেছে তার কবিতায় এইভাবে-“পাশেই খেজুরগাছ/সতেরটি শীতাতঙ্কের/সতেরটি অস্ত্রোপচারের/ক্ষতচিহ্ন-ইতিহাস/কালো-কালো দীর্ঘশ্বাস/বুকে-পিঠে নিয়ে নিরালে ঝিমায়–তার দিকে কে তাকায় ?বাস্তবে গত শীতে আমার ১টি আর এই শীতে ১ টি মোট ২টি অস্ত্রোপাচার হয়েছে যা আমার জন্য কষ্টের,বেদনার।চাদর জড়ানো গত শীতে আমি হারিয়েছি আমার পিতা ও বড় ফুফুকে এই শীতে। সকলের নিকট আনন্দের হলে ও আমার নিকট কষ্টের। তবু ও বন্ধুদের মন রক্ষার্থে যোগ দিলাম আনন্দঘন বর্ণাঢ্য স্মরণীয় আয়োজনে যা মনে থাকবে অনেক দিন অনেক বছর। স্মৃতিতে ২/ ১ টি স্মরণীয় কথা যা না লিখলে নয় তাই কলম হাতে লিখতে বসে ও ঐদিন ২৭ শে ডিসেম্বর আর লিখা হল না তাই দেরীতে খানিকটা লিখার চেষ্টা হয়ত। কারন ঐ দিন রাতে আমার বড় ফুফুর ইহলোক ত্যাগ অনেকটা আমার নিকট কষ্টের
ও বেদনার।মনে পড়ে ৯০ এর দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আমি নিউমার্কেট দোস বিল্ডিং চত্বরে প্রায় আসতাম তখন আমাদের বাসা ছিল পূর্ব মাদার বাড়ি। আমার বড় ভাই তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ছিলেন আর আমাদের বাসাটি ছিল তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র নেতাদের অলিখিত বাসস্হল।গল্প,রাজনীতি সর্বমোট সব বিষয়ে আমরা দারুন সময় উপভোগ করতাম।ঐ সময়ে মাঝে মাঝে চকবাজার আসতাম। তখন মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক ডাঃ মাহফুজুর রহমান কর্তৃক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো যার নাম ছিল সাপ্তাহিক অণুবীক্ষন।ঐ পত্রিকায় আমি আমার কবিতা পাঠাতাম -ছাপা হত।ঐ সময় সাংবাদিক আতাউল হাকিম ভাইয়ের অনুপ্রেরনায় দৈনিক পূর্বকোন পত্রিকায় ও আমার লেখা ছাপা হত। আমার জানা মতে ঐ অনুবীক্ষণ পত্রিকায় কোন না কোন দায়িত্বে ছিলেন আজকের চট্টগ্রাম কলেজ ফাউন্ডেশনের কোন না কোন দায়িত্বে থাকা গবেষক,কলামিস্ট সাখাওয়াত হোসেন মজনু।যার সাথে ২৭ শে ডিসেম্বর আবার সম্প্রীতি মেলা -১৯ এ সাক্ষাৎ যেন নতুনত্বের মাঝে পুরোনো মায়ার বাঁধন।আমার বাবা সরকারি উচ্চ পদস্হ কর্মকর্তা ছিলেন বাবার সাথে দেশের বিভিন্ন জেলায় চাকুরির প্রথা অনুযায়ী আমাদের যেতে হত।
সে যাক হোক আমি ভর্তি হলাম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে এর পর মাইগ্রেশনের আওতায় ফিরে এলাম চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে (সেশন ৯১-৯২) এর পর কেটে গেল কয়েকটি সোনালী বছর।প্রথম দিকে পরিচয় হলো বন্ধু নুরুল বশর সুজনের সাথে।এর পর আর ৪ বন্ধু মিলে অনেকের মতে চট্টগ্রাম কলেজ হতে প্রথম অাধুনিক মানসম্মত এডমিশন গাইড “ডিগনিটি” আমরাই বের করলাম।লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্হা হতে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ যে কষ্টের তা আমরা ছয় জনই হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেলাম।সকালে বের হয়ে সন্ধ্যে এক এক দিন এক একজনে খাওয়ার বিল দিতাম।সব জল্পনা,কল্পনার অবসান ঘটিয়ে চকবাজারস্হ মাইক্রোনেট কম্পিউটার কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে যখন বইটি বের হলো তখন কি যে আনন্দ আমি রেজা,সুজন হুমায়ুন,পলি,মমতাজ সকলের ভালবাসা স্মরণে রাখার মত।ক্যাম্পাসে বই বিক্রি করতে হলে এক ছাত্র নেতার অনুমতি নিতে হবে বন্ধু হুমায়ুন বলায় ঐ সময়ে শেরে বাংলা ছাত্রাবাসে গিয়ে আমি যখন অনুমতি নিয়ে বের হয়ে বিষয়টি রেজাকে জানালাম রেজা খুব খুশি হলো।আসলে বিধি বাম বইটি যখন বাজারজাত করার সব কিছু চুড়ান্ত তখন সরকার কর্তৃক জারি হয় নতুন প্রজ্ঞাপন কোন পরীক্ষা হবে না মার্কস এর উপর ছাত্র বা ছাত্রী ভর্তি করা হবে।আমাদের সমস্হ আশা ভরসা কালো মেঘে ডেকে গেল।হাতে গোনা কয়েকটি বই ছাড়া আর কোন বই বিক্রি হল না।পরবর্তীতে কেজি দরে বিক্রি করার জন্য কোন হকার ও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর কিছু দিন পর গঠন করা হল চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ,পদার্থ বিজ্ঞানের হাসনাতকে আহবায়ক ও আমাকে যুগ্ম আহবায়ক ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানের নুরুল বশরকে যুগ্ম আহবায়ক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়।ছাত্র সংগ্রামের কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে তখন টাকার প্রয়োজন। লিচু তলায় বারবার সভা করার পর ও কেউ টাকা দেয় না।একদিন হাসনাত আমাকে বলল বন্ধু এখন কি করব ?তখন আমার মাথায় বুদ্ধি এল যে আমি সবার সামনে ১০০০ টাকা দেব শর্ত পরে আমার টাকা আমি নিয়ে নেব।ওবলল দেখ কিছু করতে পার কিনা।পরদিন যেমন কর্ম তেমন ফল -লিচু তলায় আমার জ্ঞানগর্ব বক্তব্যের পর ৫০০ টাকার দুটো নোট বের করতে বন্ধু নুরুল বশর সহ ইংরেজী বিভাগের মেয়েরা সহ সবাই ১০০/২০০ করে দিল আর আমরা পেয়ে গেলাম কয়েক হাজার টাকা।মজার ব্যাপার আমি আর নুরুল বশরকে পূর্বের শর্ত অনুযায়ী হাসনাত টাকা ফেরত দিল। বাকি টাকা দিয়ে সংগঠন সামনের দিকে এগুতে লাগল।বোনাস হিসাবে চকবাজারে মদিনা হোটেলে ওর নিজের টাকায় আমাদের ভোজন করালো যা আমাকে এখনও আনন্দ দেয়।পরে জেনেছি হাসনাত ইউকে তে অবস্হান করছে। চট্টগ্রাম কলেজ (স্নাতক -সম্মান, স্নাতকোত্তর)পাঠ চুকে পরর্বতীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয় চট্টগ্রাম হতে মার্কেটিংএ এমবিএ বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ হতে আইন শাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার সময়কালের স্মৃতি আজ আমাকে তেমন নাড়া দেয় না যতটা দেয় চট্টগ্রাম কলেজ।কেননা এই কলেজের ইতিহাস বাংলাদেশে এখন একটি গবেষনার বিষয় হতে পারে।তথ্য সুত্রে জানা যায় নবাব সিরাজ উদ্ দৌল্লার পতনের মুল কারিগর ছিল কিছু কুচক্রী ও দালাল যারা আগে সক্রিয় ছিল এখন ও এই দেশে বহাল তবিয়তে।যারা ভাবছিল ইংরেজদের দালালী করে পুরো ভারত বর্ষের ধন সম্পদ লুট করবে।এখনও কোন না কোন ভাবে সে তরিকা বহাল।যখন দালাল ও ইংরেজদের খপ্পরে পুরো ভারত বর্ষ তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাধারন মানুষের আন্দোলনের দানা বাঁধে সর্বত্র।এর মধ্যে হয়ে গেল ১৮৫৭।পুরো চট্টগ্রাম আন্দোলনে সরগরম। নেতৃত্ব দিলেন মিলিটারি ব্যারাকে ৩৪ নং রেজিমেন্টের হাবিলদার রজব আলী।সে যেন এক মহাবীর।(বর্তমানে চকবাজারস্হ হাবিলদার রজব আলী নামে যে ক্লাব রয়েছে আমি সৌভাগ্যক্রমে তার বর্তমান সাধারন সম্পাদক। বিভিন্ন কারনে এর তেমন জোরালো কার্যক্রম নেই)।তখন ইংরেজরা দালালদের প্ররোচনায় এই উপমহাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতিতে ইংরেজদের কৃষ্টি,সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটাতে চেষ্টা করে।তখন চট্টগ্রামে তেমন কোন দালান কোটা ছিল না,ছিল না স্কুল,কলেজ।তখন নিজস্ব উপাসনা ভিত্তিক জ্ঞান চর্চা হতো।মুসলমানরা মক্তবে,হিন্দু বৌদ্ধরা তাদের উপাসনালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত হতো।রাস্তাঘাট ছিল না ছিল কিছু গরু বা ঘোড়ার গাড়ি।চারদিকে জঙ্গলাকীর্ণ।২২ টি কক্ষ নিয়ে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রথমে চট্টগ্রাম জিলা স্কুল যার কর্যক্রম শুরু হয় ১৮৩৬ সালে।১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমোদন এবং স্কুল কক্ষে কলেজের কার্যক্রমের প্রস্তাব করা হয়। মুলত কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৯ সালে।অর্থ সংকটে পড়ে ১৮৭০ সালে আবার কলেজটি বন্ধ হয়ে যায় ঐ সময় মিরশ্বরাই থানার আমার ইউনিয়নের পাশে ধুম ইউনিয়নের তখনকার জমিদার গোলকচন্দ্র সেনের এককালীন ১০০০০/টাকা দান করার কারনে এই কলেজের কার্যক্রম পুনরায় চালু হয় যা আজ ও অবধি চলছে সগৌরবে স্বমহিমায়।মানুষের যৌগ্যতা বিকাশের জন্য দরকার উপযুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।সেই দিক থেকে চট্টগ্রাম কলেজ অতুলনীয়।এখন প্রায় ৩০ বছর আগের কথা মনে পড়লে হৃদয়ে নিরন্তর ঝড় উঠে।আমার বিশ্বাস এই কলেজের ফটক দিয়ে বের হবে আরও অনেক নোবেল বিজয়ী সহ কীর্তিমান মানুষ।এই ধরনের একটি সফল অনুষ্ঠান আগামীতে আরও সফল অনুষ্ঠানের অনুপ্রেরনা যোগাবে এবং ফাউন্ডেশন সত্যিকারে ছাত্র-ছাত্রী ও সর্বস্তরের মানবতার কল্যানে এগিয়ে আসবে সেই প্রত্যাশা রইল।
মোঃ কামরুল ইসলাম,
লেখক- প্রাবন্ধিক,কবি ও মানবাধিকার কর্মী।