
নির্যাতন কি ?
সাধারণত কোনো ব্যক্তিকে শারীরিক ও মানসিকভাবে আঘাত করাকে নির্যাতন বলে। নির্যাতনের অভিধানিক অর্থ হচ্ছে নিগ্রহ, পীড়ন, ও অত্যাচার করা। ইংরেজি oppression এবং violence এই দুটি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে নির্যাতন। প্রতিটি নির্যাতনে দুটি প্রতিপক্ষ থাকে একজন হচ্ছে নির্যাতনকারী অন্যজন নির্যাতিত। আগেই ধারণা দেয়া হয়েছে নির্যাতন শারীরিক এবং মানসিক দুই ভাবেই হতে পারে। কাউকে প্রহার করা যেমন নির্যাতন তেমনি কাউকে মানসিকভাবে কষ্ট দেয়া বা চাপে রাখাও নির্যাতন, একে বুদ্ধিভিত্তিক নির্যাতনও বলা হয় যার মধ্যে পড়ে কাউকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা, কোনো কিছু করার জন্য মানসিক চাপে রাখা, অন্যের মতামতের গুরুত্ব না দিয়ে কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ইত্যাদি।
অন্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া;
অন্যকে ক্ষমতাবান বা স্বাবলম্বী হতে না দেওয়া;
অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চাওয়া;
অন্যের অর্জিত সুফল নিজে ভোগ করা বা অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ;
নিজের মতাদর্শ বা ধর্ম জোর করে অন্যের ওপর প্রচার করতে চাওয়া ইত্যাদি।
নারী নির্যাতন কি ?
নির্যাতন কথাটির অর্থ ব্যাপক এবং তা নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন নির্যাতন দৈহিক মনস্তাত্তিক বা আবেগগত শক্তি বা চাপ প্রয়োগের দ্বারা এমন ধরনের কাজ যা বেআইনি এবং নির্যাতিতের যন্ত্রণা ও দুর্ভোগের কারণ। ঠিক তেমনি নারী নির্যাতন নির্যাতনের অর্থও অনেক বিস্তৃত নারীরা কেবল নারী হওয়ার কারণে তার যে কোনো ধরনের অধিকারের লংঘনকে বুঝিয়ে থাকে, নারীরা প্রতিনিয়ত নানা দমন পীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। আমাদের দেশের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় যেখানে পুরুষ ক্ষমতাবান নারী ক্ষমতাহীন, এই প্রেক্ষিতে নারীর ওপর নানা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানোকেই নারী নির্যাতন বলা হয়। নারী নির্যাতনকে লিঙ্গ ভিত্তিক নির্যাতনও বলা হয়। দেখা যায় একজন নারী হবার কারণেই ধর্ষণ, হত্যা, ভ্রুণ হত্যা, বিভিন্ন প্রকার পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতন সহ নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। এছাড়াও যুদ্ধ, দাঙ্গা, জাতিগত, সম্প্রদায়গত কিংবা শ্রেণীগত নির্যাতনের সময় একটি গোষ্ঠীকে অবমাননা করার উপায় স্বরূপ কিংবা প্রতিশোধ¯পৃহা মিটানোর জন্য ঐ নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নারীদের ধর্ষণ ও নৃশংসভাবে নিপীড়ন করা হয়ে থাকে।
নারী নির্যাতনের ধরন
সাধারণত নারীরা নির্যাতন এর বিভিন্ন ধরনের লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতনের শিকার হয়। এগুলো হলো-
ক) প্রত্যক্ষ বা প্রকাশ্য শারীরিক নির্যাতনঃ এমন ধরনের নির্যাতন যা নারীর শরীরকে আক্রান্ত করে এবং এমন কোনো আক্রমণ যা নারীর শরীরের জন্য ক্ষতিকর, যার ফলে কোনো ছোট বা বড় ধরনের ক্ষত, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে যেমন- গৃহে ও কর্মক্ষেত্রে নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, শারীরিক নিপীড়ন ইত্যাদি;
খ) মানসিক নিপীড়নঃ এ ধরনের নির্যাতন মৌখিকভাবে ঘটে থাকে; এই ধরনের নির্যাতনে কিছু বলে বা কোনো রীতি আরোপ করে নারীকে আঘাত করা হয় যেমন- জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া, কুটুক্তি, উপহাস, অপবাদ দেয়া ইত্যাদি;
গ) শারীরিক ও মনস্তাত্তি¡ক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় স¤পদ থেকে বঞ্চিত করাঃ একজন নারীর কাছ থেকে কোনো কিছু নিয়ে নেওয়া বা কেড়ে নেওয়া বা বঞ্চিত করা যেমনঃ পুষ্টি, শিক্ষা, জীবিকা নির্বাহের উপায় ইত্যাদি;
ঘ) যৌন নির্যাতনঃ কোনো নারীকে (বিবাহিত/অবিবাহিত) তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য করা কিংবা ধর্ষণ করা।
ঙ) সামাজিক নির্যাতনঃ নারীকে কোনো নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আটকে রাখা, তাকে তার বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা, সব সময় নারীর ওপর নজরদারি করা, নারীর চলাফেরা ও আচার-আচরণকে সবসময় একটা খবরদারী ও জবাবদিহিতার মধ্যে রাখা ইত্যাদি। যেমন- অবরোধ প্রথা, পর্দা প্রথা, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া।
চ)অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা অর্জনের পথ রুদ্ধ করাঃ নারীর নিজের আয়সহ অন্যান্য আর্থিক স¤পদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় রাধা দেওয়া। নারীকে আর্থিকভাবে বঞ্চিত ও তার স্বামীর ওপর নির্ভরশীল করে রাখা যেমন- অর্থ জমিজমাসহ নানা উৎপাদনশীল স¤পদ থেকে বঞ্চিত করা এবং অর্জিত সম্পদের মালিকানা থেকে বঞ্চিত করা; নারীকে পন্যে পরিণত করা, যেমনঃ নারী পাচার, পতিতাবৃত্তি, পর্নোগ্রাফি, বিজ্ঞাপনে নারীর অমর্যাদাকর উপস্থাপন ইত্যাদি।
ছ) আধ্যাতিক নির্যাতনঃ ধর্মতান্ত্রিক বা আধ্যাতিক রীতিনীতি ব্যবহার করে নারীকে কোনো কাজ মেনে নিতে কিংবা কোনো কাজ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা।
জ) পারিবারিক নির্যাতনঃ নারী নির্যাতনের একটি বড় ক্ষেত্র হচ্ছে পারিবারিক নির্যাতন। নারী বাইরের কোনো ব্যক্তি দ্বারা যেমন নির্যাতিত হয়, তেমনি নিজ ঘরে বা পরিবারে স্বামী কিংবা অন্য পরিজন দ্বারাও আক্রান্ত হতে পারে। নিজ ঘরে নারীর নিগৃহীত বা নির্যাতিত হওয়াই পারিবারিক নির্যাতন- যা নারী নির্যাতনের একটি বিশেষ রূপ। নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি বিশেষ রূপ হচ্ছে এ পারিবারিক নির্যাতন।
নারী নির্যাতনের কারণঃ
নারী নির্যাতনের প্রধান কারণ হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা যেখানে পুরুষক্ষমতাবান নারী ক্ষমতাহীন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ধরেই নেয়া হয় নারী পুরুষের অধীনে থাকবে, পুরুষ নারীকে শাসন করবে, নারীর তুলনায় বেশি সুযোগ সুবিধা পাবে- এ রকম পিতৃতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা শৈশব থেকে মনের গভীরে গেঁথে যাওয়ার ফলে অধিকাংশ পুরুষ সমাজের কোথাও নারীর প্রতি কোনো বৈষম্য দেখতে পায় না।
১. নারী ও পুরুষের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে বিরাজমান অসম ক্ষমতা সম্পর্ক;
২. অর্থনৈতিক দারিদ্র;
৩. সম্পদের ব্যবহার ও বন্টনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারে নারী সীমাবদ্ধতা;
৪. পুরুষও নারীর শারীরিক কাঠামা ও মনোভাব;
৫. সামাজিকভাবে পুরুষের স্থান মেয়েদের চেয়ে উপরে, কারণ তারা আয় উপার্জন করে
৬. পুরুষেরা বংশের উত্তরাধিকার এবং নারীরা তাদের ভোগ বিলাসের সহযোগী এই ধারনা;
৭. ধর্ম, কুসংস্কার নারীদের চলাচল/মানসিক বিকাশ সীমাবদ্ধ করে দেয়;
৮. যৌতুক;
লেখকঃ তারিকুল আলম
অতিরিক্ত জেলা ম্যজিস্ট্রেট
নোয়াখালী।