করোনা কালে খাদ্য নিরাপত্তাঃ আমাদের করণীয়

নিজস্ব প্রতিবেদক

 

অপুষ্টি মূলত খাদ্য, স্বাস্থ্য ও আচরণ-এর সাথে জড়িত। বাংলাদেশে বিদ্যমান ব্যাপক অপুষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ হল পারিবারিক পর্যায়ে খাদ্য নিরাপত্তার অভাব। খাদ্য নিরাপত্তা বলতে সারা বছর বাড়ির সকল সদস্যের জন্য খাদ্যের নিরবচ্ছিন্ন প্রাপ্যতাকে বুঝায়। এটা সম্ভব পরিবারের খাদ্য ক্রয় বা উৎপাদনের সামর্থের মাধ্যমে। বাংলাদেশে পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেশ প্রকট। জনগণের এক চতুর্থাংশই প্রতিদিন ১৮০০ ক্যালরির কম খাবার গ্রহণ করে থাকে। শতকরা ১৪ ভাগ লোক প্রতিদিন ১৬০০ ক্যালরির কম খাবার গ্রহণ করে থাকে। দেখা যায় শুধুমাত্র স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা দিয়ে কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া যায় না। বিশেষ করে দারিদ্রের কারণে অনেক পরিবার পুষ্টিযুক্ত খাবার ক্রয়, উৎপাদন ও তা আহারে সক্ষম হচ্ছে না।

বিভিন্ন উপায়ে পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তা বিধানের উদ্যোগ নেয়া যায়। যেমন-
(ক) বাড়িতে পুষ্টি বাগান স্থাপনঃ
১. জনপ্রতি দৈনিক চাহিদা ১১০ গ্রাম এর বিপরীতে বাংলাদেশে যে পরিমাণ শাক-সবজি উৎপন্ন হয়, তার জনপ্রতি গড় দৈনিক পরিমাণ ৩০ গ্রামের মত।
২. বসতভিটায় সারা বছর ভিটামিন-এ এবং লৌহ সমৃদ্ধ শাক সবজি ও ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়।
৩. পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী, প্রসূতি ও কার্যক্ষম মহিলাদের সারা বছর ভিটামিন-এ ও লৌহ সমৃদ্ধ শাক-সবজি ও ফল জাতীয় খাবার গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়।
৪. পুষ্টি, পুষ্টি বাগান (সবজি বাগান), পরিবারের সদস্যদেরও ব্যক্তিগত পুষ্টির চাহিদা সম্পর্কে সচেতন করে তোলা।
৫. পরিবারের পুষ্টিহীনতা সমস্যা দূরীকরণের পাশাপাশি নগদ আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা। বাংলাদেশে প্রায় আড়াই কোটি বসতবাড়ি রয়েছে। আর বসতবাড়ির মাত্র ১ শতাংশ (ডেসিমেল) বা ১ টুকরা জমিতে সারা বছর পর্যায়ক্রমে সুপরিকল্পিতভাবে চাষ করে হরেক রকম শাক সবজির প্রয়োজন মেটানো সম্ভব।
(খ) বাড়িতে হাঁস মুরগি পালনঃ
১. গরীব পরিবারে পরিকল্পিতভাবে হাঁস-মুরগী পালনের মাধ্যমে অধিক মাংস ও ডিম উৎপাদনে উৎসাহিত করা।
২. পরিবারের আয় বৃদ্ধি এবং খাদ্যে পরিবর্তন এনে পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে মা-শিশু, কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টিমান বৃদ্ধি করা।
৩. উন্নত জাতের হাঁস-মুরগী পালন করা।
(গ) মাছ চাষঃ
১. আধুনিক প্রযুক্তিতে ক্ষুদ্র পরিসরে মাছ চাষে উৎসাহিতত করা।

দুস্থ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন (ভিজিডি) প্রদানঃ
যাদের নিজস্ব জমিজমা নেই তাদের সরাসরি খাদ্য সাহায্য, কাজের বিনিময়ে খাদ্য(কাবিখা), কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা), বৃক্তিমুলক প্রশিক্ষণ এবং বিনামূল্যে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেবার মাধ্যমে উন্নয়ন করতে হবে। এই জনগোষ্ঠীর সহায়তা প্রদান করে দুস্থ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন (দারিদ্র নিরসন, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি) করা যায়।

খাবার সংরক্ষণঃ
(ক) শাকসবজি -যে সব শাক-সবজি কাঁচা খাওয়া হয়, সেগুলো উৎপাদনের সময় মল সাব ব্যবহার করা উচিত নয়। মল সার ব্যবহার করা হলে শাক সবজি খাওয়ার আগে ভাল করে ধুয়ে সিদ্ধ করে রান্না করা উচিত।
(খ) মাংস- কাঁচা বা অর্ধসিদ্ধ মাংস খাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। জীবাণু সংক্রমিত অথবা দূষিত মাংস খেলে প্রচন্ড বমি ও ডায়রিয়া, কৃমি সংক্রমণ এবং অন্যান্য অসুখ বিসুখ হতে পারে, যা কখনো মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গরু, খাসি ইত্যাদি স্বাস্থ্যসম্মত এবং রোগ প্রতিরোধ পদ্ধতিতে জবাই করা উচিত। জবাই এর পশু সুস্থ হতে হবে। জবাইকৃত পশু ঝুলিয়ে রেখে সমস্ত রক্ত বের করে দিতে হবে। কসাইখানার চতুর্দিকে বেড়া দিয়ে আবদ্ধ ও পরিস্কার রাখতে হবে। জবাইকৃত পশুর নাড়ি ভুড়ি ছাড়ানোর সময় কোন রোগাক্রান্ত অঙ্গ (যেমন-কৃমি আক্রান্ত লিভার) পুড়িয়ে ফেলতে অথবা মাটিতে পুঁতে রাখতে হবে, কুকুরকে দেয়া যাবে না।
(গ) মাছ- মাছ খুব ভাল খাদ্য। কিন্তু গরমকালে কোন কোন সময় মাছ ধরার কয়েক ঘন্টার মধ্যে এটা পচে যেতে পারে। রোগ জীবাণু ও বিষক্রিয়াজনিত অনেক রোগ মাছ থেকে ছড়াতে পারে, বিশেষ করে দূষিত পানি থেকে মাছ ধরা হলে অথবা কাঁচা বা অর্ধসিদ্ধ অবস্থায় খেলে। তাজা মাছ সব সময়: ১. যত শীঘ্র সম্ভব রান্না করা উচিত; ২.সরাসরি রোদ বা শুস্ক বাতাস থেকে দূরে রাখা উচিত; ৩.যতটা সম্ভব ঠান্ডা রাখা উচিত ; ৪.রান্না করে দেরি না করে খাওয়া উচিত।
(ঘ) দুধ-দুধ একটি আদর্শ খাদ্য। ভিটামিন ‘সি‘ ব্যতীত সব রকমের পুষ্টি উপাদান দুধের মধ্যে আছে। তবে দূষিত দুধের মাধ্যমে গবাদি পশু থেকে মানুষের মধ্যে কয়েকটি রোগ ছড়াতে পারে। গবাদি পশুর ময়লা দ্বারা সেটা দূষিত হতে পারে। যে দুধ দোহন করে তার হাতের ময়লা বা কাশি থেকে দুধ দূষিত হতে পারে এবং এভাবে তা রোগ ছড়ায়। সারা দিনের জন্য দুধ রাখতে হলে, ৪/৫ ঘন্টা অন্তর জাল দিতে হবে। পরের দিনের জন্য রাখতে হলে, ভালোভাবে ফুটিয়ে, কীটপতঙ্গ, ইঁদুর ও বিড়ালের নাগালের বাইরে ঠান্ডা জায়গায় রাখুন। খাওয়ার আগে পরের দিন সকালে আবার ভালোভাবে ফুটিয়ে নিন। দুধ দোহন বা কেনার পরে জাল না দিয়ে বেশিক্ষণ রেখে দিলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া দুধ রৌদ্রে রেখে দিলে ভিটামিন ও খনিজ লবন নষ্ট হয়ে যায়।
(ঙ) ডিম- শরীর গঠনের জন্য অপরিহার্য খাদ্য উপাদান ডিম থেকে পাওয়া যায়। ডিম ও দুধকে আদর্শ খাদ্য হিসেবে অভিহিত করা হয়। ডিম সব সময় রান্না করে খাওয়া উচিত। কোন অবস্থাতেই কাঁচা খাওয়া ঠিক নয়। ডিমের খোসা ভাঙ্গা থাকলে এর ভিতর রোগের জীবাণূ বিশেষ করে Salmonella ঢুকে যেতে পারে এবং এই ডিম খেলে আমরা অসুখে আক্রান্ত হতে পারি। গর্ভবতী, স্তন্যদায়ী ও শিশুদের পুষ্টির উন্নতির জন্য প্রতিদিন ডিম খাওয়া উচিত।
(চ) ফল- টাটকা ফলের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন ও খনিজ উপাদান যা শরীরের জন্য খুব উপকারী। ধুয়ে অথবা খোসা ছাড়িয়ে টাটকা অবস্থায় ফল খাওয়া উচিত।

রান্না করা খাদ্য সংরক্ষণের উপায়ঃ
এমন একটি পরিস্কার পাত্রে খাবার রাখুন যাতে কিছুক্ষণ আগে পানি ফোটানো হয়েছে অথবা যা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে মুছে নেয়া হয়েছে। পাত্রটি পরিস্কার কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখুন। মশামাছি, কীটপতঙ্গ ইঁদুর এবং অন্যান্য জীবজন্তু থেকে সুরক্ষিত ঠান্ডা স্থানে রাখুন। গ্রীষ্মকালে জনগণ অনেক সময় খাবার পানি ঘরের কোনায় ছায়াতে রাখে। এতে পানি ঠান্ডা থাকে। খাবার পানির পাত্রের কাছে রান্না করা খাবার রাখা ভালো। এতে খাবার ঠান্ডা থাকবে এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যে নষ্ট হবে না। পানি রাখার জন্য যদি মাটির পাত্র ব্যবহার করা হয় তাহলে পাত্রের চারিদিকের জায়গা আরো ঠান্ডা থাকবে।

কিভাবে খাদ্যের দূষণ প্রতিরোধ করতে হয়ঃ
যারা খাদ্য ধরা ছোঁয়া করে, প্রস্তুত করে এবং পরিবেশন করে তাদের উচিত পরিস্কার পানি ও সাবান দিয়ে ভালো করে দুই হাত ধুয়ে নেয়া। হাতের আঙ্গুলে কোন ক্ষত থাকলে তা পরিস্কার ভাবে ব্যান্ডেজ করে রাখা উচিত। টেবিল অথবা যে স্থানে খাবার প্রস্তুত করা হয় সেই স্থান এবং ব্যবহৃত বাসন কোসন পরিস্কার রাখা উচিত। যে সব মহিলা বাড়িতে খাবার প্রস্তুত করেন, তাদের দেখিয়ে দিন কি করে যথাযথভাবে হাত ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হয় এবং নখ পরিস্কার রাখতে হয়। যে সব লোক রেস্টুরেন্ট এবং খাবার দোকানে কাজ করে তাদের দেখিয়ে দিন কি করে হাত ধুয়ে ও শুকিয়ে নিতে হয়। মাঝ মধ্যে এলাকার জনসাধারণকে মনে করিয়ে দিন, খাবার স্পর্শ করার আগে বিশেষ করে পায়খানা থেকে আসার পর, তারা যেন সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত ধুয়ে নেয়।

নিয়মিতভাবে জনগণকে মনে করিয়ে দেয়া উচিত:
১. একসাথে শুধু একবেলার খাবার তৈরি করতে, যদি অবশিষ্ট খাবার তারা ঠান্ডা করে রাখতে না পারে।
২. রান্না করার সঙ্গে সঙ্গে খাবার খেয়ে নিতে, উষ্ণ স্থানে খাবার অনেকক্ষণ ফেলে রাখা উচিত নয়।

ভেজাল খাদ্য এর বিরুদ্ধে করণীয়ঃ
বিভিন্ন ভাবে খাদ্যে ভেজাল দেয়ার কারণে বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য বিরাট হুমকির সম্মুখীন। অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের অতি মুনাফার লোভে এই গর্হিত কাজটি করে থাকে। বর্তমানে বাজার অনেক ভেজাল পণ্যে সয়লাব। খুব সহজে যেসব পণ্যে ভেজাল মেশানো যায় সেগুলো হলো- তেল, ঘি, দুধ, আটা, ময়দা, মধু, বিভিন্ন গুড়া মসলা ইত্যাদি। ভোক্তারা নিজের অজান্তেই এসব ভেজাল খাদ্য খেয়ে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে।

মন্তব্য ঃ বর্তমানে মাছসহ বেশ কিছু পণ্য পচঁনের হাত থেকে রক্ষার জন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা ফরমালিন এবং ফল পাকানোর জন্য কার্বাইড ব্যবহার করছে। এ দু’টি কেমিক্যালই স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে আমাদের জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ভেজাল খাবার তৈরি বা বাজারজাতকরণের বিরুদ্ধে সরকার ২০০৫ সালে একটি আইন পাশ করেছে যা “Bangladesh Pure Food Amendment Act-2005” নামে পরিচিত। এই আইনের আওতায় অসাধু প্রস্তুতকারক বা ব্যবসায়ীদের সর্বনিম্ন ৫০,০০০/- টাকা জরিমানা ও ৬ মাস জেল এবং সর্বোচ্চ ৩,০০,০০০/- টাকা জরিমানা ও ৩ বৎসরের জেল দেয়ার বিধান আছে। এছাড়া মোবাইল কোট এর মাধ্যমে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ ও নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ এর মাধ্যমে ভেজাল কারবারের সাথে সংশ্লিষ্ঠ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বেশী শাস্তি নিশ্চিত করা যায় ।

 

লেখক: তারিকুল আলম
অতিরিক্ত জেলা ম্যজিস্ট্রেট
নোয়াখালী।

সোস্যাল নেটওয়ার্ক

সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত