
লেখকঃ
তারিকুল আলম
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট
নোয়াখালী।।
‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা, চিরবিজয়িনী জাগো জয়ন্তিকা’।
শিল্প উন্নয়ন, নগর উন্নয়ন, শিক্ষা ও উন্নত জীবন পাশাপাশি চলে আসার কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধেরও উন্মেষ ঘটে থাকে। বত©মানে সারা বিশ্বে নারীদেরকে ‘নরকের দরজা’ বিবেচনা করার পরিবর্তে ‘উন্নয়নের সিংহদুয়ার’ হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এ কারণেই নারীদের ক্ষমতার বৃদ্ধির জন্য The Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination against Women (CEDAW) গঠনের পাশাপাশি এ সনদে স্বাক্ষরকারী সব দেশে নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করছে। একই সাথে বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা থাকায় তাহা প্রতিপালনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে ।
নারী ক্ষমতায়ন মূলত শুরু হয়ে থাকে পরিবারের কাছ থেকে । পরিবারে যদি নারীরা তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে পরিবারের গুরুত্বপূণ© সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে ব্যপক ভূমিকা রাখতে পারেন। বতমানে নারীদের ক্ষমতায়নের যুগ চলছে। নারীর পেশা ও পুরুষের পেশা আর আলাদা করে ভাবা হচ্ছে না। নারী বরং আরও এক ধাপ এগিয়ে। যে কাজ এতকাল পুরুষের একান্ত নিজস্ব বলে ধারণা করা হতো, সেখানেও নারী অংশ নিচ্ছেন। মানুষের ধারণাতে এটাই বদ্ধমূল ছিল, ঘরের কাজ, সন্তান লালন পালন ও বয়স্কদের সেবা করাই নারীর কাজ। আর অর্থ উপার্জনমূলক বাইরের কাজ পুরুষের। কিন্তু এ কথা সঠিক নয় যে, নারীরা উপাজ©নমূলক কাজে করতে পারেন না। পরিবেশ ও সুযোগ পেলে নারীরা তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন, যাহা ইতোমধ্যে নারীরা প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছে।
আমাদের দেশে সাধারনত একজন পুরুষ পরিবারে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন। কখনো তিনি বাবা, কখনো স্বামী, ভাই বা সন্তান। সংসার পরিচালনা করা ও সন্তান লালন-পালনে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি যেভাবে পিতৃসুলভ দৃষ্টি দিয়ে সন্তানকে দেখেন, সেই দৃষ্টি দিয়ে পরিবারের একজন নারী হোক তার মা, মেয়ে, স্ত্রী অথবা বোনকে সেভাবে দেখলে বা তাদের অধিকার নিশ্চিত করলে নারীর ক্ষমতায় ও জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য। নারীর ক্ষমতায়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে (ক) নারীর শিক্ষা এবং (খ) অধিকার নিশ্চিত করে জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠা করা। আর এ কাজে পুরুষকে অবশ্যই সহায়তা করতে হবে। পুরুষের সহযোগিতামূলক মনোভাবের মাধ্যমেই নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য দূর করে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম হতে পারে।
পরিবার হচ্ছে একটি শিশুর গড়ার মূল ভিত্তিস্থল। শিশুটি যখন ছোটবেলা থেকেই দেখবে তার পরিবারে নারীর প্রতি সম্মান দেখানো হয়, নারীকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়, নারীর অধিকার নিশ্চিত করা হয়, তখন শিশুটি বড় হয়েও সেই চর্চা করবে, নারীর প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করবে। তখনই নারীদের জন্য নিরাপদ সমাজ তৈরি হবে, তাদের অধিকার নিশ্চিত হবে, নারীর ক্ষমতায়নের পথ সুগম হবে। সুতরাং পরিবার থেকেই একটি শিশুকে কিভাবে নারীকে শ্রদ্ধা করতে হয় তা শেখাতে হবে।
শুধু আইন দিয়ে নারীর ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যাবে না। নারীর ক্ষমতায়ন হবে না। নারীকে সমাজে শুধু নারী নয়, একজন মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। সেভাবে তার প্রতি আচরণ করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- এটা নারীর কাজ, এটা পুরুষের কাজ এই বিভাজন বন্ধ করতে হবে। আর নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি না হলে এখন যেসব নারী বাইরে কাজ করছেন তারাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। এতে দেশের সামগ্রিক অথ©নৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।
নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম আর নারী-পুরুষের সমতার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার উপরে। দেশে ২৮ বছর ধরে রাষ্ট্র পরিচালনায় রয়েছেন নারীরা। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে আমরা অনেক দেশের আগে। নারী উন্নয়ন আর অগ্রগতিতে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ ও হাইকোট© বিভাগের বিচারপতি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, সিভিল সার্ভিস, পুলিশ বাহিনী, র্যাব, সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, মেরিন একাডেমী, সাংবাদিকতা, আইনজীবী থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীরা সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। তৃণমূল পর্যায়েও নারীর ক্ষমতায়ন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক নারী নির্বাচিত হয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে স্থানীয় সরকার, সংসদ, পোশাক কারখানা সর্বত্রই নারী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। আইলা, সিডরসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় প্রতিকূল পরিবেশে নারীরা সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবেলা করেছে।
কৃষিক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে এবং নারীর ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো- নারীবান্ধব পরিবেশ এখনো সব জায়গায় তৈরি করা সম্ভব হয়নি। কর্মক্ষেত্র এমনকি নিজ পরিবারেও নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি বৈষম্য রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য অবশ্যই নারী-পুরুষের সমতা দরকার। এ জন্য পরিবার ও সমাজ সব ক্ষেত্রেই নারীর সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে এবং নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। নারীকে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াসই পারে নারীর ক্ষমতায়নের পথ সুগম করতে।
বর্তমান সরকার অনেক কাজ করে যাচ্ছে নারীর উন্নয়নে, সর্বক্ষেত্রে যার ফলাফল দেখা যাচ্ছে । নারী-উন্নয়ন সংক্রান্ত ফোকাল পয়েন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে সব মন্ত্রণালয়ে, বিভাগীয় অফিসে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সকল সরকারি দপ্তর সমূহে। জাতীয় পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নারীর সার্বিক অথ©নৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের উপর। অনেক কৌশল ঠিক করা হয়েছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়। এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে উন্নীত হবে নারীর ক্ষমতায়ন । আর নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেলে জেন্ডার সমতা সৃষ্টি হবে। ফলে নারীর সামর্থ্য, দায়িত্ব ও কত©ব্য বৃদ্ধি পাবে । নারীর অর্থনৈতিক প্রাপ্তি সম্প্রসারিত হবে ও সামাজিক ভাবে নারীদের মান মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। একই সাথে নারীর নিজস্ব মতামত প্রকাশ বেড়ে যাবে ও মতপ্রকাশের মাধ্যমে সৃষ্টি হবে উন্নয়নের একটি সক্রিয় পরিবেশ।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি, আমাদের কন্যারা নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারবে আর তাদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে হাজারও জয়ন্তিকা, যারা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির চলমান অথ©নৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ধারাকে করবে আরও অনেক বেশি বেগবান ও ত্বরান্বিত। ২০৪১ সালের সোনার বাংলাদেশ গঠনের নিমিত্তে অর্জিত অথ©নৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন টেকসই হবে নারীদের হাত ধরে।
তথ্যসূত্র :
(i) www.un.org
(ii) www.wikipedia.org
(iii) www.mowca.gov.bd